উৎপাদন || Production
উৎপাদন কাকে বলে?
সাধারণ অর্থে উৎপাদন বলতে কোনো কিছু সৃষ্টি করাকে বোঝায়। কিন্তু অর্থনীতিতে ‘উৎপাদন’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। মানুষ নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। সে শুধু প্রকৃতি প্রদত্ত বস্তুর রূপ ও অবস্থার পরিবর্তন এবং স্থানান্তরের মাধ্যমে নতুন উপযোগ সৃষ্টি করতে পারে । এটাই অর্থনীতিতে উৎপাদন হিসেবে পরিচিত। উৎপাদন বলতে মূলত উপযোগ সৃষ্টি করাকে বোঝায়। উৎপাদিত দ্রব্যের বিনিময় মূল্য থাকতে হবে।
আবার উপযোগ সৃষ্টি না হলে উৎপাদন বোঝায় না। উপকরণ বা প্রাথমিক দ্রব্য ব্যবহার করে নতুন কোনো দ্রব্য বা উপযোগ সৃষ্টি করাকে উৎপাদন বলে। যেমন: আটা, লবণ, পানি ইত্যাদি ব্যবহার করে রুটি বানানো হয়। রুটি একটি উৎপাদিত নতুন দ্রব্য। রুটি খেয়ে আমরা ক্ষুধা নিবারণ করি বা তৃপ্তি পাই ৷ অর্থাৎ রুটি তৈরি করে উপযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। আমরা টাকা বা অন্য দ্রব্যের বিনিময়ে রুটি পেতে পারি। অর্থাৎ রুটির বিনিময় মূল্য আছে।
অর্থনীতিবিদরা বিভিন্নভাবে এর সংজ্ঞা প্রদান করেছেন— ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড মার্শালের (Alfred Marshall) মতে, “এ বস্তুজগতে মানুষ প্রকৃতি প্রদত্ত বস্তুকে অধিকতর উপযোগী করে তোলার উদ্দেশ্যে এরূপ পুনর্বিন্যাস করে যাতে , তাকে অধিকতর কার্যোপযোগী করা যায় ।”
অস্ট্রেলীয় অর্থনীতিবিদ বার্নার্ড উইলিয়াম ফ্রেজার বলেন, “যদি ভোগ বলতে উপযোগের ব্যবহার বোঝায়, তবে উৎপাদন বলতে উপযোগ সৃষ্টি করা বোঝায়। অতএব উৎপাদনকে একটি রূপান্তর প্রক্রিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়, যার মাধ্যমে নতুন উপযোগ সৃষ্টি হয়। উল্লেখ্য, উৎপাদিত পণ্যের উপযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি বিনিময় মূল্য থাকাও আবশ্যক।
উৎপন্ন কী?
অর্থনৈতিক কার্যাবলির ফলাফলই হলো উৎপন্ন। মোট উৎপন্নের মধ্যে আছে দ্রব্য ও সেবা। দ্রব্য আবার দুভাগে বিভক্ত— ভোগ্য দ্রব্য ও উৎপাদকের বিনিয়োগ দ্রব্য।
উৎপাদনের উপকরণ
উৎপাদন প্রক্রিয়াতে ব্যবহৃত সীমিত যোগানবিশিষ্ট যেকোনো বস্তু বা সেবাকে উৎপাদনের উপকরণ (Resource) বলা হয়। প্রকৃতির উপাদান (বাতাস, সূর্যের আলো ইত্যাদি) ছাড়া মাটি, খনিজ ও জলজ পদার্থ, মানুষের শারীরিক বা মানসিক ক্ষমতা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি যা কিছু উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়, তাকেই উৎপাদনের উপকরণ বলে অর্থনীতিতে বিবেচনা করা হয়। উৎপাদনের চারটি প্রধান উপকরণ রয়েছে। যেমন— ১. ভূমি, ২. শ্রম, ৩. মূলধন ও ৪. সংগঠন।
১. ভূমি (Land): উৎপাদনে সাহায্য করে এমন ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদকে ভূমি বলে। মাটি, মাটির উর্বরাশক্তি, খনিজদ্রব্য, বনজ ও জলজ সম্পদ, সূর্যকিরণ, বৃষ্টিপাত, আবহাওয়া প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদ ভূমির অন্তর্গত।
২. শ্রম (Labour): উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত মানুষের সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমকে শ্রম বলে। এ অর্থে জেলে বা ঠেলাগাড়ির চালকের শারীরিক পরিশ্রম যেমন শ্রম, তেমনি ডাক্তার বা উকিলের বুদ্ধিজাত প্রচেষ্টাও শ্রম।
৩. মূলধন (Capital): যেসব দ্রব্যসামগ্রী মানুষের শ্রমের দ্বারা উৎপাদিত এবং সরাসরি ভোগের জন্য ব্যবহৃত না হয়ে পুনরায় উৎপাদনের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত হয় অর্থনীতিতে সেগুলোকে মূলধন বলে। অর্থাৎ, মূলধন হলো উৎপাদনের উৎপাদিত উপাদান। মূলধন প্রকৃতির দান নয়, এটি মনুষ্যসৃষ্ট। যন্ত্রপাতি , কাঁচামাল, কলকারখানা প্রভৃতি হলো মূলধন।
৪. সংগঠন (Organization): উৎপাদন ক্ষেত্রে ভূমি, শ্রম ও মূলধন একত্রিত করে ও তাদের মধ্যে উপযুক্ত সমন্বয় ঘটিয়ে উৎপাদন কাজ পরিচালনা করাকে সংগঠন বলে। এ কাজ যে ব্যক্তি সম্পাদন করে তাকে সংগঠ উদ্যোক্তা বলে। তাই উদ্যোক্তার বিভিন্ন কাজ, যেমন কোনো কিছু উৎপাদনের পরিকল্পনা প্রণয়ন, ভূমি, শ্রম ও মূলধন একত্রীকরণ ও তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন, ঝুঁকি নিয়ে উৎপাদন কাজ পরিচালনা ইত্যাদি।
কোনো কিছু উৎপাদনে ভূমি, শ্রম, মূলধন এবং সংগঠন— এ চারটি উপকরণের যৌথ অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এগুলোর মধ্যে যেকোনো একটির অভাব হলে উৎপাদন সম্ভব নয়। অবশ্য উৎপাদনক্ষেত্রে সব উপকরণের গুরুত্ব এক রকম নয়। অবস্থাভেদে কোনো উপকরণ বেশি আবার কোনো উপকরণ কম প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান ও জনবহুল দেশ বলে এখানে মূলধন ও সংগঠনের তুলনায় ভূমি ও শ্রমের গুরুত্ব বেশি । আবার যুক্তরাষ্ট্র শিল্পপ্রধান দেশ বলে সেখানে ভূমি ও শ্রমের তুলনায় মূলধন ও সংগঠনের গুরুত্ব অনেক বেশি।
উৎপাদনের বৈশিষ্ট্য১. উৎপাদনে বস্তুগত উপকরণ বা উপাদান ব্যবহৃত হয়, ২. কারিগরি জ্ঞান যুক্ত হয়, ৩. যন্ত্রপাতি যুক্ত হয়, ৪. সময় যুক্ত থাকে,৫. ক্রুগত উৎপাদন যা চূড়ান্ত ফল নির্দেশ করে, ৬. বিনিময় মূল্য প্রযোজ্য হয়, ৭. উপযোগ সৃষ্টি হয়।
একটি দেশের উৎপাদন যেসব বিষয়ের ওপর নির্ভর করে সেগুলো হলো—
১. সম্পদের পরিমাণ ও উৎকর্ষ,
২. উৎপাদন পদ্ধতি,
৩. মৌলিক সুবিধা তথা অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ওপর,
৪ . আবহাওয়া, পর্বত, নদী, বন্যা, সাইক্লোন ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক অবস্থা এবং
৫. দেশের রাজনৈতিক অবস্থা প্রভৃতি।
উৎপাদনে প্রযুক্তির প্রকারভেদ
উৎপাদনে বিভিন্ন উপাদান স্থির ধরে সমাজে প্রচলিত কারিগরি জ্ঞানের সহায়তায় শ্রম ও মূলধনের একটি অনুপাত ব্যবহারের মাধ্যমে যে উৎপাদন কৌশল নির্ধারণ করা হয়, তাকে উৎপাদনে প্রযুক্তি বলে।
অধ্যাপক হিস তিন ধরনের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কথা উল্লেখ করেছেন।
১. মূলধননিবিড় প্রযুক্তিগত কৌশল (Capital Intensive Technology): মূলধন > শ্রম অর্থাৎ K > L
২. শ্রমনিবিড় প্রযুক্তিগত কৌশল (Labour Intensive Technology): শ্রম > মূলধন অর্থাৎ L > K
৩. নিরপেক্ষ প্রযুক্তিগত কৌশল (Neutral Technology): মূলধন = শ্রম অর্থাৎ K = L
২. শ্রমনিবিড় প্রযুক্তিগত কৌশল (Labour Intensive Technology): শ্রম > মূলধন অর্থাৎ L > K
৩. নিরপেক্ষ প্রযুক্তিগত কৌশল (Neutral Technology): মূলধন = শ্রম অর্থাৎ K = L
অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে শ্রম বেশি কিন্তু মূলধন কম। আবার উন্নত দেশে মূলধন বেশি কিন্তু শ্রম কম ব্যবহৃত হয়। তাই অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে শ্রমনিবিড় কৌশল বেশি উপযুক্ত এবং উন্নত দেশে মূলধননিবিড় কৌশল বেশি প্রয়োগ করা হয়।