খন্দকের যুদ্ধ || Battle of the Trenche
খন্দকের যুদ্ধ (মার্চ ও এপ্রিল, ৬২৭ খ্রিস্টাব্দ) |
খন্দকের যুদ্ধের কারণ
কুরাইশরা ওহুদের যুদ্ধে জয়লাভ করলেও মুসলমানদের বিনাশ করতে পারেনি। তাদের পক্ষে মদিনা অধিকারও সম্ভব হয়নি। তাই তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন করে আঘাত হানার ফন্দি আঁটে । ইহুদিরাও তাদের সাথে যোগ দেয়। বদর ও ওহুদের যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতক ‘ বনু কাইনুকা ' এবং ' বনু - নজীর " নামক দুটি ইহুদি গোত্র সন্ধির শর্ত খেলাফ করে শত্রুপক্ষকে নিয়মিতভাবে সাহায্য করায় অপরাধী সাব্যস্ত হয়। বিচারে তাদেরকে নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তারা খাইবারে আশ্রয় গ্রহণ করে মক্কাবাসীকে সর্বপ্রকার সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতিতে মদিনা আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করে। তারা সমগ্র আরব পরিভ্রমণ করে সব সম্প্রদায়ের লোকদেরকে মদিনার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে । ফলে আবার যুদ্ধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে।
মদিনার পার্শ্ববর্তী এলাকার বেদুইনগণ উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করতো এবং লুটতরাজ করে জীবিকা অর্জন করতো। এজন্য মহানবি ( স ) তাদেরকে কয়েকবার শাস্তি প্রদান করে সৎ ও সুন্দরভাবে জীবন - যাপনের পরামর্শ দেন। তারাও এবার গোপনে কুরাইশদের সাথে হাত মিলিয়ে মহানবি ( স ) ও ইসলামের সর্বনাশের জন্য ওয়াদাবদ্ধ হলো।
মুসলমানগণ ওহুদের যুদ্ধে পরাজিত হয়েও সর্বশান্ত হননি এবং মহানবি ( স ) সে যুদ্ধে আক্রান্ত হয়েও নিহত হননি , বরং মহানবির বলিষ্ঠ নেতৃত্বে তারা অধিকতর শক্তিশালী হয়েছে বলে কুরাইশগণ যখন জানতে পারে তখন তারা আবার মদিনা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। তাদের সামাজিক , রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের খাতিরে তারা শেষবারের মতো এবং চূড়ান্তভাবে মদিনাবাসী মুসলমানদের সাথে লড়াই করার জন্য তৈরি হতে লাগল। মদিনা শহর লুণ্ঠনের আশায় এবার মক্কার গাতফান প্রভৃতি গোত্রও কুরাইশদের সাথে যোগদান করে।
খন্দকের যুদ্ধের ঘটনাবলি
৬২৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ওহুদ যুদ্ধের বিজয়ী নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কুরাইশ , ইহুদি ও বেদুইন জাতির বীরগণ সমবেতভাবে মদিনা শহরকে ধূলিসাৎ করতে অগ্রসর হলো। তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ১০,০০০।
মহানবি ( স ) শত্রু বাহিনীর কথা পূর্ব হতেই অবগত হয়ে ক্রয়ী শক্তির আক্রমণের মোকাবিলার জন্য মাত্র ৩,০০০ সৈন্য সংগ্রহ করলেন। কীভাবে শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করা হবে তা ঠিক করার জন্য তিনি সাহাবাদের সাথে আলোচনা করেন। পারস্যের জনৈক মুসলমান সলমন ফারসির পরামর্শক্রমে মদিনার অরক্ষিত স্থান সমূহে গভীর পরিখা খনন করে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৬ দিন কঠোর পরিশ্রম করে এ খনন কার্য শেষ করা হয়। মহানবি (স ) স্বয়ং এ খনন কার্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শিশু ও নারীদেরকে নিরাপদ দুর্গে ও গম্বুজে আশ্রয় দিবার ব্যবস্থা করা হয় । এরপর সৈন্যবাহিনীকে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত করে নগর রক্ষার প্রহরায় নিযুক্ত করা হয়। ৬২৭ খ্রিস্টাব্দের ৩১ শে মার্চ তারিখে এ যুদ্ধ শুরু হয়।
পরিখা খনন করে মদিনা শহরকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল বলে এ যুদ্ধকে পরিখার যুদ্ধ বলা হয় । আরবি ভাষায় পরিখার প্রতিশব্দ খানদাক। তাই এ যুদ্ধকে খানদাকের যুদ্ধও বলা হয় । ইংরেজি ভাষায় এ যুদ্ধকে Battle of the Confederates বা সম্মিলিত শক্তিসমূহের যুদ্ধ ’ বলা হয়েছে । পবিত্র কুরআন মজিদে এটি ‘ আহজাবের যুদ্ধ ' নামে অভিহিত হয়েছে।
মক্কা - বাহিনী বিনা বাধায় মদিনার উপকণ্ঠে এসে মদিনার আত্মরক্ষার এক অভিনব কৌশল দেখে বিস্মিত হলো। আপ্রাণ চেষ্টা করেও তারা শহরে প্রবেশ করতে অসমর্থ হলো । তবুও তারা তিন সপ্তাহের অধিককাল ধরে মদিনা অবরোধ করে রইল । অবশেষে বৃষ্টি , ঝড় - ঝঞ্ঝা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে শত্রুপক্ষের ঘোড়াগুলো মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং তাদের তাঁবুগুলোও উড়ে যায়। তাদের আহার্য দ্রব্যাদিও নিঃশেষ হয়ে গেল । বেদুইন ও ইহুদিগণ হতাশ হয়ে পড়ে এবং কুরাইশগণ ছুটে পালায়।
হযরতের ( স ) অপূর্ব রণকৌশল , গোয়েন্দা তৎপরতা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুসলমানগণ জয়লাভ করে এবং শত্রুপক্ষের মদিনা বিজয়ের স্বপ্ন চিরতরে ধূলিসাৎ হলো। এ যুদ্ধে ৬ জন মুসলমান ও ৩ জন মক্কাবাসী প্রাণ হারায়।
হযরতের ( স ) অপূর্ব রণকৌশল , গোয়েন্দা তৎপরতা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুসলমানগণ জয়লাভ করে এবং শত্রুপক্ষের মদিনা বিজয়ের স্বপ্ন চিরতরে ধূলিসাৎ হলো। এ যুদ্ধে ৬ জন মুসলমান ও ৩ জন মক্কাবাসী প্রাণ হারায়।
খন্দকের যুদ্ধের ফলাফল
এ যুদ্ধের ফলাফল লক্ষ করে ডক্টর ইমামুদ্দিন যথার্থ বলেন , “ উক্ত সম্মিলিত বাহিনীর ভাঙ্গনের ফলে মক্কাবাসীদের সম্পূর্ণ পরাজয় প্রতিভাত হয় এবং মদিনার মুসলিম রাষ্ট্রের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। ——যার আধিপত্য অল্প সময়ের মধ্যে আরব এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর বিস্তার লাভ করে।"
এ যুদ্ধে শুধু কুরাইশদের পরাজয় হয় নি — ইহুদি সম্প্রদায়ের নাশকতার এবং বেদুইনদের শত্রুতারও অবসান হয়েছিল।
অল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস, শৃঙ্খলা রক্ষা ও আত্মোৎসর্গের জন্য মুসলমানগণ এ যুদ্ধে জয়লাভ করেন। কুরাইশগণ ও সারা বিশ্ব বুঝল ইসলাম ধর্ম মরবে না এবং একে কেউই ধ্বংস করতে পারবে না। মুসলমানদের শক্তি এ যুদ্ধের পর বহু গুণে বর্ধিত হলো।
এ যুদ্ধে মুসলমানগণ জয়লাভ করার ফলে পার্শ্ববর্তী বহু জাতি সেচ্ছা হযরত মুহাম্মদ (স) -এর প্রভুত্ব স্বীকার করেন। তাদের অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে । হযরত (স) এ যুদ্ধের পর হতেই মদিনার একচ্ছত্র শাসকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হলেন। বিশ্বাসঘাতক ইহুদি গোত্র বানু কুরাইজাকে চিরতরে উৎখাত করা হয় । ইসলামের ইতিহাসে এ যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম।
হুদাইবিয়ার সন্ধি ( ৬২৮ খ্রিস্টাব্দ )
ধর্মের খাতিরে মহানবি ( স ) ও মোহাজেরগণ মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিযরত করেন। আর দীর্ঘ ছয় বছর ধরে তার স্বদেশ ছেড়ে মদিনায় বসবাস করছিলেন। এ ছয় বছর ধরে তাঁরা প্রিয় মাতৃভূমিও দর্শন করেননি , হজ্বও সমাধা করতে পারেননি । তাই তাঁদের মন মাতৃভূমির জন্য ব্যাকুল ছিল।
পবিত্র জিলকদ মাসে আরবের প্রধানুযায়ী যুদ্ধ - বিগ্রহ ছিল হারাম। তাই মহানবি ( স ) ষষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাসে মাতৃভূমি দর্শন এবং উমরাহ ব্রত পালন করার উদ্দেশ্যে হজ্বের পোশাকে ১,৪০০ সাহাবি সমভিব্যাহারে মদিনা হতে মক্কার দিকে যাত্রা করেন। কুরবানীর জন্য ৭০ টি উটও সঙ্গে নেয়া হলো। যেহেতু হজ্বব্রত পালন করার জন্য চরম শত্রুকেও সুযোগ দেয়া হয়, তাই হযরতও ( স ) বাধাপ্রাপ্ত হবেন না মনে করে মক্কার দিকে অগ্রসর হন। তাঁদের আগমনের সংবাদ জানতে পেরে কুরাইশগণ মুসলমানদের অগ্রগতি প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে খালিদ ও ইকরামার নেতৃত্বে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন।
পবিত্র জিলকদ মাসে আরবের প্রধানুযায়ী যুদ্ধ - বিগ্রহ ছিল হারাম। তাই মহানবি ( স ) ষষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাসে মাতৃভূমি দর্শন এবং উমরাহ ব্রত পালন করার উদ্দেশ্যে হজ্বের পোশাকে ১,৪০০ সাহাবি সমভিব্যাহারে মদিনা হতে মক্কার দিকে যাত্রা করেন। কুরবানীর জন্য ৭০ টি উটও সঙ্গে নেয়া হলো। যেহেতু হজ্বব্রত পালন করার জন্য চরম শত্রুকেও সুযোগ দেয়া হয়, তাই হযরতও ( স ) বাধাপ্রাপ্ত হবেন না মনে করে মক্কার দিকে অগ্রসর হন। তাঁদের আগমনের সংবাদ জানতে পেরে কুরাইশগণ মুসলমানদের অগ্রগতি প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে খালিদ ও ইকরামার নেতৃত্বে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন।
মক্কার খোজা সম্প্রদায়ের বুদাইলের কাছে কুরাইশদের দুরভিসন্ধির কথা জানতে পেরে মহানবী (স) মক্কার উপকণ্ঠে ৯ মাইল দূরে হুদাইবিয়া নামক এক ঝরণার পাশে শিবির স্থাপন করেন। তিনি বুদাইল মারফত কুরাইশগণকে জানালেন যে, তাঁরা শুধু হজ করতে এসেছে যুদ্ধ করতে নয়। তারা হযরতের (স) সততায় বিশ্বাস স্থাপন করে আবওয়া - বিন মাসুদকে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে মহানবির ( স ) নিকট পাঠায়। কিন্তু আবওয়ার দুর্ব্যবহারের জন্য আলোচনা ব্যর্থ হয়।
কিন্তু হযরত ( স ) কুরাইশদের সাথে সন্ধি স্থাপন করার জন্য প্রথমে খেয়াস এবং পরে হযরত ওসমানকে ( রা ) শান্তির প্রস্তাব নিয়ে কুরাইশ নেতাদের নিকট পাঠান। ওসমানকে ( রা ) তারা আটক করে রাখলে জনরব উঠল যে , কুরাইশগণ ওসমানকে ( রা ) হত্যা করেছে । জীবন উৎসর্গ করে মুসলিম যোদ্ধাগণ ওসমান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য বার আত নিলেন— একে ‘ বায় আতুর ব্রিজওয়ান ' বলা হয়।
এ শপথ এক গাছের নিচে গ্রহণ করা হয় বলে একে বারজাতুস শাজারা ও বলা হয়। ভয়ে কুরাইশগণ হযরত ওসমানকে (রা) মুক্তি দেয় এবং সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে সুহাইলকে পাঠায়। হযরত (স) সানন্দে এই শান্তি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। অনেক যুক্তিতর্কের পর যে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়, তা ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত। হুদাইবিয়ার সন্ধির প্রধান প্রধান শর্ত নিচে বর্ণিত হলো—
১. মুসলমানগণ সে বছর হজ্ব সম্পাদন না করে মদিনায় ফিরে যাবেন।
২. ইচ্ছা করলে পরের বছর মুসলমানগণ হজ্ব করতে আসতে পারবেন । কিন্তু তাঁরা তিন দিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবেন না এবং শুধু আত্মরক্ষার জন্য কোষবদ্ধ তরবারি ছাড়া অন্য কোনো মারণাস্ত্র তাঁরা সঙ্গে আনতে পারবেন না।
৩. মুসলমানদের মক্কায় তিন দিন অবস্থানের সময় কুরাইশগণ নগর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করবে।
৪. কুরাইশ ও মুসলমানদের মধ্যে আগামী দশ বছরের জন্য যুদ্ধ - বিগ্রহ বন্ধ থাকবে।
৫. আরবের যে কোনো গোত্র ইচ্ছা করলে মুহাম্মদ ( স ) অথবা কুরাইশদের সাথে সন্ধি - সূত্রে আবদ্ধ হতে পারবে। এতে কোনো পক্ষই কোনো ওজর আপত্তি করতে পারবে না।
৬. কোনো মক্কাবাসী অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিরেকে মদিনায় আশ্রয় প্রার্থনা করলে যদিনার মুসলমানগণ তাকে আশ্রয় দিতে পারবে না। পক্ষান্তরে কোনো মুসলিম মদিনা হতে মক্কায় চলে আসলে মক্কাবাসীদের উপর ডাকে প্রত্যর্পণের কোনো দায়িত্ব বর্তাবে না।
৭. হজ্বের সময় মুসলমানদের জান - মাল নিরাপদ থাকবে এবং মক্কার বণিকগণ মদিনার পথ দিয়ে নির্বিঘ্নে সিরিয়া এবং অন্যান্য দেশের সাথে ব্যবসা - বাণিজ্য করতে পারবে।
৮. চুক্তির মেয়াদকালে উভয় পক্ষের জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে এবং কোনো প্রকার লুণ্ঠন ও আক্রমণ চলবে না।
৯. সন্ধির শর্তাবলি উভয় পক্ষ কর্তৃক পুরোপুরি প্রতিপালিত হবে।