উহুদের যুদ্ধ || Battle of Uhud

 

উহুদের যুদ্ধ (২১শে মার্চ,৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) 
উহুদের যুদ্ধের কারণ 
বদরের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে কুরাইশগণ ভগ্নোদ্যম হয়ে পড়ে। কিন্তু মদিনার স্বার্থপর ইহুদিগণ কাব্য ও রম্যরচনার মাধ্যমে এবং কুমন্ত্রণার সাহায্যে আবার কুরাইশদেরকে সতেজ করে তুলতে তৎপর হলো। শুধু কুরাইশদেরকে নয় , বেদুইনদেরকেও তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলে।

বদরের যুদ্ধের পর মদিনার ক্রমোন্নতি এবং দ্রুতগতিতে ইসলামের প্রসার লাভ মক্কাবাসিগণ কিছুতেই সহা করতে পারল না। এ ছাড়াও এ যুদ্ধে পরাজয় বরণ করায় কুরাইশদের রাজনৈতিক প্রাধান্য এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ ও সুযোগ - সুবিধা সবই বিনষ্ট হতে লাগল। কাজেই তারা আরও একবার মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জোর প্রস্তুতি গ্রহণ করে। বদরের যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি এবং শাইবা , উভবা , আবু জেহেল প্রমুখ বীরের মৃত্যুর কথা মক্কাবাসী কোনোক্রমেই হজম করতে পারলো না। তারা এর প্রতিশোধ গ্রহণে বদ্ধপরিকর হলো এবং কুরাইশ নেতৃবর্গ ঘোষণা করলো যতদিন তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করে মুসলমানদেরকে সমুচিত শাস্তি না দিতে পারবে ততদিন পর্যন্ত তারা সর্বপ্রকার আরাম - আয়েস ভোগে বিরত থাকবে এবং তৈল বা নারী স্পর্শ করবে না।

হযরত মুহাম্মদ ( স ) ছিলেন বানু হাশিম গোত্রের লোক। তাঁর নেতৃত্বে বানু হাশিমের সাফল্য বানু উমাইয় গোত্রের গৌরব ও প্রতিষ্ঠার মর্মমূলে চরম আঘাত করেছিল। কুরাইশ বণিকগণ তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য আবু সুফিয়ানের হাতে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও ব্যয়সাপেক্ষে অনেক টাকা পয়সা দিল। বিখ্যাত তীরন্দাজ ওহশীকে কুরাইশগণ তাদের দলভুক্ত করে নেয়। সমরসজ্জায় অনেক অর্থব্যয় করে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। আবার যুদ্ধের উন্মাদনা প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে।


উহুদের যুদ্ধের ঘটনাবলি
তৃতীয় হিজরীতে কুরাইশগণ ৭০০ বর্মধারী , ৩০০ উষ্ট্রারোহী ও ২০০ অশ্বারোহীসহ মোট ৩,০০০ সৈন্যসহ আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মদিনা অভিযানে অগ্রসর হয় । সৈনিকদেরকে উৎসাহিত করার জন্য বহু কুরাইদ নারী ও কবি এ যুদ্ধে শ্রীক হয়েছিল। তারা দশদিন অগ্রসর হওয়ার পর মদিনার ৫ মাইল পশ্চিমে ওহুদ উপত্যকায় এসে উপস্থিত হয়। 
এ অশুভ সংবাদ শুনে হযরত ( স ) ঠিক করলেন যে , মদিনা শহরের অভ্যন্তর ভাগ হতেই শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করা হবে। হযরত ( স ) তাঁর পরিকল্পনার বিবরণও তাঁর সাহাবাদেরকে জানালেন।

ঐতিহাসিক মুহম্মদ আলীর মতে , হযরতের (স) এই পরিকল্পনা যুবক মুসলমানদের কাছে মনঃপুত হলো না। তাঁরা মদিনার বাইরে। যেয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য জেদ ধরে বসে। হযরতকে (স) শেষে রাজি হতে হলো। ২ অশ্বারোহী , প্রায় ১০০ জন বর্মধারী এবং প্রায় ৫০ জন তীরন্দাজসহ ১০০০ মুজাহিদের এক বাহিনী সমভিব্যাহারে হযরত (স) কুরাইশ শিবিরাভিমুখে অগ্রসর হতে লাগলেন। বেগতিক দেখে পথিমধ্যে মুনাফেক আব্দুল্লাহ বিন উবাই তাঁর ৩০০ জন অনুচর নিয়ে সরে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ৭০০ মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে হযরত শুদ্বুদ ময়দানে উপস্থিত হলেন।
 
মহানবি (স) উহুদ পর্বতকে পশ্চাতে রেখে আপন সৈনাবাহ রচনা করলেন। মুসলিম শিবিরের পিছনে বাম পাশে একটি গিরিপথ ছিল। দূরদর্শী সমরকুশলী নবি (স) সে গিরিপথে শত্রুগণ আক্রমণ করতে পারে এ আশঙ্কায় আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর নামক জনৈক সেনানায়ককে ৫০ জন তীরন্দাজসহ ওষুদের সে গিরিসঙ্কটে মোতায়েন রাখলেন। তাঁর উপর হযরতের (স) নির্দেশ রইল , জয় কিংবা পরাজয় কোনো অবস্থাতেই যেন তিনি স্থান ত্যাগ না করেন।

৬২৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে মার্চ (মতান্তরে ২৬ শে মার্চ) এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। মল্লযুদ্ধ দিয়ে এ যুদ্ধের সূচনা হয়। মল্লযুদ্ধে মহাবীর হামযার কাছে তালহা নিহত হয়। এর পর মুসলমানগণ বিপুল বিক্রমে শত্রু সৈন্যবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কুরাইশগণ ছত্রভঙ্গ ও দিশেহারা হয়ে পালাতে লাগে। বিজয়োল্লাসে মুসলিম বাহিনী তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে এবং শত্রু বাহিনীর শিবির লুটতরাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মহানবির (স) আদেশ উপেক্ষা করে তীরন্দাজ বাহিনীও ছাতল মুসলিম বাহিনী তাদের স্থান ত্যাগ করে লুটতরাজে যোগ দেয়। মহাবীর খালিদ কুরাইশ বাহিনীকে সংহত করে সুড়ঙ্গ পথে বিপুল বিক্রমে মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণ করে। যুদ্ধের মোড় পরিবর্তিত হলো এবং ছত্রভঙ্গ মুসলিম বাহিনী হযরতের ( স ) শত চেষ্টায়ও একত্রিত হতে পারলো না। পরাজিত হয়ে মুসলিম বাহিনী পলায়ন করতে লাগল। স্বয়ং মহানবি ( স ) ইবনে কামিয়া কর্তৃক আক্রান্ত হলেন। ইঁট ও প্রস্তরের আঘাতে তাঁর দুটি দাঁত শহিদ হয়ে গেল। মুসলিম বাহিনীর পতাকাধারী মুসআব নিহত হলেন। তাঁর আকৃতি হযরতের ( স ) মতো ছিল বলে শত্রুপক্ষে গুজব রটে যে , স্বয়ং মহানবি ( স ) নিহত হয়েছেন। 

অবশ্য কিছুক্ষণের জন্য তিনি সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন। জ্ঞান ফিরে আসার সাথে সাথে তিনি উঠে দাঁড়ান। হযরত আলী , আবু বকর প্রমুখ বিশিষ্ট ১১ জন সাহাবি তাঁদের জীবন বিপন্ন করেও মহানবির ( স ) চারপাশে দুর্ভেদ্য ব্যুহ রচনা করেন এবং আহত হযরতকে ( স ) সাথে নিয়ে পর্বতারোহণ করেন। শত্রুদল তাদেরকে ব্যর্থভাবে অনুসরণ করেছিল। 

উহুদের যুদ্ধে হযরত হামযাসহ মোট ৭৪ (৭০ জন আনসার ও ৪ জন মোহাজের) জন মুসলিম মুজাহিদ শহিদ হন এবং অপরপক্ষে মাত্র ২৩ জন কুরাইশ সৈন্য নিহত হয়। মুসলিম মুজাহিদ শহিদানের নাসিকা ও কর্ণ ছেদন করে কুরাইশ নারীরা মালা গেঁথে চরম বীভৎসতার পরিচয় দিয়েছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা হামযার (রা) হৃৎপিণ্ড চর্বণ করে এক অমানুষিক পৈশাচিক দৃশ্যের সৃষ্টি করেছিল।

মুহাম্মদের ( স ) আদেশ তীরন্দাজগণ কর্তৃক অবহেলা করার জন্য মুসলমানদের পরাজয় হয়েছিল। লুটতরাজে এত বেশি ব্যস্ত হওয়ায় তাদের নীচতা ও বৈষয়িক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছিল। সত্যের জন্য লড়াই করতে গিয়ে এরূপ বস্তুবাদী মনোবৃত্তির জন্য মুসলমানদের শিক্ষার প্রয়োজন ছিল। তাই তাদেরকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিকূল বায়ুপ্রবাহও মুসলমানদের পরাজয়ের আর একটি কারণ ছিল। অধিকন্তু , খালিদ বিন ওয়ালিদের সামরিক দক্ষতা ও রণনিপুণতা মুসলমানদের পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। খালিদ - বিন - ওয়ালিদ তখনও মুসলমান হননি। তিনি কুরাইশদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বীর ছিলেন। মুসলমানদের অশ্বারোহী বাহিনী ছিল না । খালিদের নেতৃত্বে কুরাইশ অশ্বারোহী বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ মুসলমানদের বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ।


উহুদের যুদ্ধের ফলাফল 
ওহুদের যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য এক কঠোর অগ্নিপরীক্ষা। আল্লাহ পাক ওহুদের যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমানদের বিশেষ করে হযরতের (স) ধৈর্য ও ঈমান পরীক্ষা করেছিলেন। আর সে পরীক্ষায় হযরত (স) কৃতকার্যতা লাভ করেন। নেতার আদেশ অমান্য করে মুসলিম সৈনিকগণও অবশ্যম্ভাবী জয় অর্জনে ব্যর্থ হয়ে এক মহান শিক্ষা লাভ করে। পরবর্তীকালে আর কোনো যুদ্ধেই মুসলিম সৈন্যবাহিনী ঐরূপ মারাত্মক ভুল করেনি। মুসলমানদের জন্য এ যুদ্ধে পরাজয় পরোক্ষ আশীর্বাদস্বরূপ ছিল। 

অপরপক্ষে মক্কাবাসিগণ যুদ্ধে জয়লাভ করলেও তাদের ক্ষতির পরিমাণ এত অধিক ছিল যে , তারা বিজয়োল্লাস করতে সমর্থ হয়নি । তারা কোনো মুসলমানকে বন্দী করে নিয়ে যেতে পারেনি এবং যদিনা নগরীকেও আক্রমণ করতে সাহস পায়নি। তারা স্ব-স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করে।
 
অবশ্য আবু সুফিয়ান যখন অবগত হলো যে , যুদ্ধে মহানবি (স) নিহত হন নি , তখন সে আবার বদর প্রান্তরে তাঁর সাথে মোকাবিলা করার জন্য অগ্রসর হলো। কিন্তু মুহাম্মদের (স) সংঘবদ্ধ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সৈন্যদল দর্শনে ভীত হয়ে পশ্চাদপসরণ করে । ইসলামের ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় বদরের যুদ্ধ নামে পরিচিত।


বীর মাওনার দুর্ঘটনা
উহুদের যুদ্ধের পর জনৈক নজদবাসী আবুল বারার অনুরোধে মহানবি ( স ) ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য ৪০ জন বা ৭০ জন মুসলিম ধর্ম প্রচারককে পাঠান। বীর মাওনা নামক স্থানে উপস্থিত হয়ে উক্ত দলটি বনি আমির গোত্রের অন্যতম নেতা আমির - ইবনে - তোফায়েলের নিকট দূত মারফৎ মহানবির ( স ) একখানা ইসলামের দাওয়াত পত্র পাঠান। পত্র হস্তগত হবার সাথে সাথে তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে দূতকে হত্যা করে এবং বীর মাওনায় সসৈন্যে গমন করে বাকি ৬৯ জনের মধ্যে ৬৭ জন মুসলমানকে হত্যা করেন। বিনা যুদ্ধে এত বেশি শিক্ষিত মুসলমানের মৃত্যু ইসলামের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url