পরিবেশ রসায়নের প্রয়োজনীয়তা || Paribes rasayaner proyojoniyota

পরিবেশ রসায়ন 

 বিজ্ঞানের যে শাখায় পরিবেশ গঠনকারী রাসায়নিক উপাদানসমূহের উৎস, তাদের মধ্যে সংঘটিত রাসায়নিক বিক্রিয়া, বিক্রিয়ায় উৎপন্ন দ্রব্যসমূহ এবং জীবকুলের উপর প্রারম্ভিক উপাদানগুলির প্রভাব (ভালো বা মন্দ) ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়, তাকে পরিবেশ রসায়ন (Environmental Chemistry) বলে। প্রকৃতপক্ষে পরিবেশ রসায়ন সম্পর্কিত আলোচনার সঙ্গে বিজ্ঞানের বিবিধ শাখার যেমনঃ পদার্থবিদ্যা, জীব রসায়নবিদ্যা, জীববিদ্যা, কৃষিবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, জন-স্বাস্থ্যবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়সমূহ জড়িত।

পরিবেশ রসায়নের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব

পরিবেশ রসায়ন অধ্যয়ন করে নিম্নরূপ বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা যায়: 
১। পরিবেশে উপস্থিত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের কু-প্রভাব অর্থাৎ জীবকুলের উপর তাদের বিষক্রিয়া সম্বন্ধে জানা যায়।
২। মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে আপাত সুফলদায়ী যেসব রাসায়নিক দ্রব্য প্রস্তুত করে চলেছে সেসব পদার্থ ও উপজাত পদার্থগুলির কু - প্রভাব সম্বন্ধে জানা যায়। 
৩। এসব কু - প্রভাব সম্পন্ন রাসায়নিক পদার্থগুলোর উৎস, তাদের বিষক্রিয়ার প্রকৃতি এবং বিষক্রিয়ার মাত্রা সম্বন্ধে জানা যায়। 
পরিবেশ রসায়ন অধ্যয়ন শুধুমাত্র ত্রুটি বিষয় সম্পর্কিত অধ্যয়নই নয় । পরিবেশ সম্পর্কিত সচেতনতা এর প্রধান লক্ষ্য। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে বিজ্ঞানের শাখার যেমন উদ্ভব , বিকাশ ও ব্যাপ্তি দেখা দিয়েছে তথাপি মানুষ প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপক অপচয় ও অপব্যবহার করছে নিজস্ব সম্পদ ভেবে । কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ যে শুধু মানুষের নিজস্ব সম্পদ নয় এটির উপর সৃষ্টির সমস্ত জীবের সমান অধিকার আছে সেটিও মানুষ ভুলতে বসেছে।

সুস্থ পরিবেশে বসবাস করার অধিকার প্রতিটি মানুষের যেমন রয়েছে , তেমনি অন্যান্য প্রতিটি জীবেরও রয়েছে । আমাদের নিজেদের কর্মকান্ড দ্বারাই পৃথিবীর পরিবেশ দূষিত ও কলুষিত হচ্ছে এবং পরিবেশ বসবাসের অযোগ্য হচ্ছে । তাই প্রতিটি মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে । পরিবেশ সংক্রান্ত অধ্যয়ন মানুষের এখন মৌলিক চাহিদা । তাই পরিবেশ রসায়ন অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলোঃ

 ১। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশ রসায়নের ভূমিকা: প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক প্রকৃতি নিজেই। তথাপি মানুষের কর্মকান্ড দ্বারা প্রতিনিয়ত পরিবেশের স্থিতিশীলতা ক্ষুন্ন হচ্ছে। এ জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকছে না। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ একান্ত প্রয়োজন। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকলে পরিবেশ স্থিতিশীল থাকে ফলে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক বিকাশ সম্ভবপর হয়।

২। দৈনন্দিন মৌলিক চাহিদা পুরণে পরিবেশ রসায়নের ভূমিকা: মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরনের জন্য একমাত্র নির্ভরশীল উপাদান হলো প্রকৃতি । আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির একমাত্র উৎস প্রাকৃতিক পরিবেশ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অন্ন , বস্ত্র , বাসস্থান , জ্বালানী ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর মানুষের অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে ফলে মানুষ ও অন্যান্য জীবের জন্য জীবন ধারণের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ফলে খাদ্য শৃঙ্খলসহ শক্তি প্রয়োগের ধারা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।

৩। দূষণরোধে পরিবেশ রসায়নের ভূমিকা: দূষণরোধে বিভিন্ন দূষকের উৎস নির্ধারণপূর্বক তা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করা। আমরা তিনটি উপায়ে দূষণ রোধ করতে পারি-
ক. ব্যক্তিগত বা স্বকীয় উপায়
খ. প্রাযুক্তিক উপায়
গ. আইনসম্মত উপায়

৪। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে পরিবেশ রসায়নের ভূমিকাঃ পরিবেশের অন্যতম উপাদান জীবমণ্ডল। জীবমণ্ডলে বিরাজমান সকল প্রকার জীবের পারস্পরিক আছঃ ক্রিয়ার মাধ্যমেই খাদ্য শৃঙ্খলা বজায় থাকে। ফলে শক্তি প্রবাহ অক্ষুন্ন থাকে। এ জন্য অণুজীব থেকে সকল শ্রেণীর জীবই পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জীব ও অঞ্জীব উপাদান এক অদৃশ্য বদনে আরত। বান, হল, অন্তরীক্ষ্যে বিরাজমান সকল প্রকার জীবের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে জীববৈচিত্র্য। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষনের জন্য পরিবেশ রসায়নের অধ্যয়নের কোন বিকল্প নেই।

৫। জীবন ধারনে পরিবেশ রসায়নের ভূমিকাঃ পরিবেশের জীব ও অজীব উপাদানের মিথোস্ক্রিয়ার ফলেই প্রকৃতিতে জীবের জীবন ধারণ সম্ভব। উদ্ভিদ সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরির সময় সৌর শক্তি রাসায়নিক শক্তি হিসাবে আবদ্ধ হয় এবং প্রাণীর বিপাকক্রিয়া পরিচালনার জন্য অজীব প্রয়োজনীয় উপাদান অক্সিজেন নির্গত হয়। একইভাবে প্রাণীর বিপাকক্রিয়ায় সৃষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইড উদ্ভিদ কর্তৃক ব্যবহৃত হয় ফলে উদ্ভিদ থেকে প্রাণীর মধ্যে খাদ্য প্রবাহের সূচনা হয় এবং পারস্পরিক মিথোস্ক্রিয়ার ফলে প্রকৃতিতে জীবের জীবন ধারণ সম্ভব হয়। পরিবেশ রসায়ন অধ্যয়নের মাধ্যমেই আমরা এ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারি। 

৬। পরিবেশ সংরক্ষণে পরিবেশ রসায়নের ভূমিকাঃ মানুষের নানাবিধ কর্মকান্ডে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য । সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশগত নানা ধরণের বিপর্যয়-যার প্রভাব পড়ছে সরাসরি পরিবেশের উপর। পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা পরিবেশ বিপর্যয় কমাতে পারি। পাশাপাশি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারি। পরিবেশ সংরক্ষণ তথা পরিবেশ বিপর্যয় রোধে পরিবেশ রসায়ন অধ্যয়নের বিকল্প নেই। 

৭। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়াতে পরিবেশ রসায়নের ভূমিকাঃ পরিবেশ রসায়ন অধ্যয়নের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে জানা যায়। ফলে এ সমস্যা সমাধান তথা নিয়ন্ত্রনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা সহজতর হয়। 

পরিবেশ রসায়নের পরিসর 

বর্তমানে পরিবেশ জীববিজ্ঞানের পরিসর ব্যাপক বিস্তৃত। প্রাকৃতিক কমিউনিটির সাথে বর্তমানে বায়োলজিক্যাল সমীক্ষা, দূষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রক, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট হওয়ায় পরিবেশ রসায়নের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবেশ দূষণ রোধের ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পরিবেশ রসায়নের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে । পরিবেশ রসায়নের জ্ঞান চর্চা ও বৃদ্ধির মাধ্যমে বিভিন্ন শাখায় এই বিজ্ঞানটি আলোক্তি হচ্ছে। ফলে এর পরিসর এখন আর পূর্বের ন্যায় সংকীর্ণ নয় বরং ব্যাপক ও প্রশস্ত। নিম্নে পরিবেশ বিজ্ঞানের পরিধির কতিপয় দিক আলোকপাত করা হল— 

১। পরিবেশের ভারসাম্যঃ বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের নানাবিধ কর্মকান্ডের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের নানাভাবে বিপর্যয় ঘটেছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য পরিবেশ রসায়নের ভূমিকা বিদ্যমান। 

২। পরিবেশ দূষণঃ শিল্প কলখারখানা, যানবাহন, ইট ভাটা ইত্যাদি বাড়ার সাথে সাথে পানি, বায়ু, শব্দ ইত্যাদি দূষণ বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন এ সকল সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশ রসায়নবিদদের এ বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় গতি সঞ্চারিত হয়েছে। 

৩। প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণঃ এর মাধ্যম প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও সংরক্ষণ কৌশল সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায় । ফলে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলা ও ভবিষ্যতের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষনের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করা যায়।

৪। বিজ্ঞান ভিত্তিক পর্যালোচনাঃ জীব সম্প্রদায়ের বিস্তৃতি , উৎপাদন , বিবর্তন ও প্রাচুর্য্যের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা করা যায়।

৫। পরিবেশের সাথে সম্পর্কঃ পরিবেশ বিজ্ঞানের মাধ্যমে অভ্যন্তরীন ক্রিয়া , আন্তঃক্রিয়া ও পরিবেশের সাথে সম্পর্ক জানা যায়।

পরিবেশ রসায়নের সাথে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সাথে সম্পর্ক 

পরিবেশ রসায়ন বর্তমানে আলোচিত বিজ্ঞানের অন্যতম একটি শাখা। পরিবেশের নানা ধরণের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এর পরিধি যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অন্যান্য বিজ্ঞানের সাথে এর সংবন্ধন দৃঢ় হয়েছে। এর সমস্যাসমূহ নিজস্ব বিষয়ভিত্তিক হলেও সমাধানের জন্য বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সহায়তা গ্রহণ অনিবার্য হয়ে পরে। পরিবেশ রসায়নের প্রধান উপাদান হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কৃষক , তাদের উৎপত্তি এবং জীব ও উদ্ভিদের উপর এদের প্রতিক্রিয়া । তাই জীববিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলির সহিত এর নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। 

 শুধু জীববিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলিও পরিবেশ বিজ্ঞানের সহিত সম্পর্কযুক্ত। উদ্ভিদ ও প্রাণীর সাথে যেমন পরিবেশ রসায়নের আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে , ঠিক তেমনি পদার্থবিজ্ঞান, ভূগোল, আবহাওয়া বিদ্যা, সমুদ্র বিজ্ঞান, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, খনিজ বিজ্ঞান ইত্যাদির সাথেও নিবিড় যোগসূত্র বিদ্যমান কেননা বিজ্ঞানের এ সকল শাখা ছাড়া সেখানে পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যয়ন এবং বিশ্লেষণমূলক পর্যালোচনা একবারেই অসম্ভব। 

পরিবেশ বিপর্যয় এবং সংরক্ষণ ভিত্তিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য পদার্থবিজ্ঞান , আবহাওয়া বিজ্ঞান, ভূগোল, রসায়ন বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার গুরুত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পরিবেশের গঠনগত উপাদান যেমন-বায়ুমন্ডল, বারিমন্ডল, অশ্মমন্ডল ও জীবমন্ডলের বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি, তাৎপর্য শুধুমাত্র পরিবেশ রসায়নের ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ওজোন স্তরের গঠন, ওজোন স্তরের ক্ষয় , মৃত্তিকার গঠন, মৃত্তিকার ক্ষয়, বায়ুমন্ডলের গঠন ইত্যাদির ব্যাখ্যার জন্য রসায়ন, পদার্থ, ভূগোল ইত্যাদির সাহায্য ছাড়া অসম্ভব। 

তাই বলা যায়, বর্তমানে পরিবেশ রসায়ন একটি সার্বজনীন বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। যেখানে বিজ্ঞানের সকল শাখার প্রয়োগ অনস্বীকার্য।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url