পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের উপায় || Paribesh dusan niyantraner upay

 পরিবেশ দূষণ 

বিভিন্ন দূষকের প্রভাবে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের (বিশেষ করে বায়ু , মাটি ও পানি) ভৌত, রাসায়নিক, তেজস্ক্রিয় পরিবর্তন হেতু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবজগতের উপর নেতিবাচক ও ক্ষতিক প্রভাব ফেলাকে পরিবেশ দূষণ (Environmental pollution) বলে।

প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক পরিবেশে যেসব উপাদান নেই, কোন কারণে তাদের উপস্থিতি বা কোন স্বাভাবিক উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি যা মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের ক্ষতি করে তাকে পরিবেশ দূষণ বলে।

দূষণ হচ্ছে বায়ু, মাটি ও পানির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যের অনাকাঙ্খিত পরিবর্তন যা মানবজীবন বা কাঙ্খিত প্রজাতি আমাদের শিল্পজাত জীবন ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের জন্য ক্ষতিকর।

পরিবেশ দূষণের প্রকারভেদ 

পরিবেশ দূষণ বিভিন্ন ভাবে হতে পারে। যেমনঃ 
১. বায়ু দূষণ (Air pollution): সাধারণভাবে বায়ুদূষকের প্রভাবে সৃষ্ট দূষণই হলো বায়ু দূষণ। যে সকল পদার্থ প্রাকৃতিক কারণে বা মনুষ্যসৃষ্ট দুষ্ট আচরণের কারণে উৎপন্ন হয়ে বায়ুমন্ডলে মিশে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে মানুষসহ অন্যান্য জীবের স্বাস্থ্যহানি ঘটায় তাদেরকে বায়ু দূষক (Air pollutant) এবং এ ঘটনাকে বায়ু দূষণ (Air pollution) বলে। নিম্নে কয়েকটি বায়ু দূষকের উদাহরণ দেয়া হলোঃ 

ক. অজৈব গ্যাসীয় দূষক এর মধ্যে রয়েছে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই সালফারের অক্সাইড, নাইট্রোজেনের অক্সাইড, হাইড্রোজেন হাইড্রোকার্বন শ্রেণীভুক্ত যৌগসমূহ। 

খ. পার্টিকেল টাইপ দূষকের মধ্যে রয়েছে ধোঁয়া, ধূলিকণা, ধাতব কণা, ধাতব অক্সাইড কণা, বাস্তব লবণের কণা; উড়ন্ত ছাই (ফ্লাই অ্যাশ) প্রভৃতি অক্সাইড, সালফাইড।

গ. জৈব বায়ু দূষক এর মধ্যে রয়েছে মিথেন, বেনজিন, টলুইন, ইত্যাদি।

২. পানি দূষণ (Water pollution): যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন এক বা একাধিক ক্ষতিকারক বহিরাগত পদার্থের সংযোজনের ফলে পানির ভৌত রাসায়নিক এবং জীব বৈজ্ঞানিক ধর্মের এবং পানীয় জনের ক্ষতিকর পরিবর্তন ঘটে তাকে পানি দূষণ (Water pollution) বলা হয়। অথবা যে প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক বা মনুষ্য সৃষ্ট কর্মকান্ড পানির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যসমূহকে বিচ্যুতির মাধ্যমে উহার সার্বজনীন ব্যবহার সমূহকে বিনষ্ট করে তাকে পানি দূষণ (Water pollution) বলে। নিম্নে কয়েকটি পানি দূষকের উদাহরণ দেয়া হলোঃ  আজৈব দূষকের মধ্যে রয়েছে এসিড ও ক্ষার, দ্রবীভূত ও অদ্রবণীয় লবণ, পলিফসফেট এবং বিভিন্ন ধরনের জৈব দূষক হিসেবে বিভিন্ন ধরনের জৈব যৌগ, তৈল অন্যতম।

৩. মাটি দূষণ (Soil pollution): যে প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের অবাঞ্চিত পদার্থসমূহ অর্থাৎ মাটি কৃষকসমূহ দ্বারা মাটির গুনাগুন নষ্ট হয়ে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় তাকে মাটি দূষণ (Soil pollution) বলে এবং যে সকল পদার্থ দ্বারা মাটি দূষিত হয় তাদেরকে মাটি দূষক (Soil pollutant) বলে। যেমনঃ বিভিন্ন প্রকার সার, পেস্টিসাইড, প্লাস্টিক, বার্ণিশ দ্রব্য, বিভিন্ন ধরনে ধাতব কণা , ব্যাটারি , জ্বালানী অবশেষ , ধাতব পাত্র প্রভৃতির প্রত্যেকে এক একটি মাটি দূষক।

৪. শব্দ দূষণ (Sound pollution): কোন শব্দ শ্রবণ ইন্দ্রিয় এর স্বাভাবিক শ্রবণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়ে ইন্দ্রিয়ের ক্ষতি সাধন করে পরিবেশ দূষণ ঘটায় তাকে শব্দ দূষণ (Sound pollution) বলে। মেঘের গর্জন, ঝড়, সাইক্লোন, সমুদ্রের ঢেউ এর শব্দ, হারিকেনের শব্দ , বাঘ ও সিংঘের গর্জন , রাস্তার কুকুরের ডাক , বাদ্যযন্ত্রের শব্দ , পরিবহনজনিত শব্দ , শিল্পজাত শব্দ , মাইকের শব্দ, প্রেসের শব্দ প্রভৃতির কারণে শব্দ দূষণ হয়ে থাকে।

৫. তেজস্ক্রিয় দূষণ ( Redioactive pollution): বিভিন্ন উৎস যেমনা নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র , নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর , নিউক্লিয়ার টেস্ট , নিউক্লিয়ার স্থাপনা , আকরিক উত্তোলন ও পরিশোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানিতে তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রবেশ করে পানিকে দূষণ করে।

৬. তাপীয় দূষণ ( Thermal pollution ): তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র , পারমাণবিক কেন্দ্র , ইস্পাত কারখানা , তৈল শোধনাগার , পেট্রোকেমিক্যাল কারখানা ও অন্যান্য শিল্প কারখানায় যন্ত্রপাতি ঠান্ডা রাখার জন্য প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক পানি প্রয়োজন হয় এং তা গরম অবস্থায় প্রাকৃতিক পানি প্রবাহে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং যার ফলশ্রুতিতে তাপ দূষণের মাধ্যমে পানি দূষিত হয়।

৭. শিল্পজাত দূষণ (Industrial pollution): বিভিন্ন শিল্প কারখানার বর্জ্যা পরিবেশের যে দূষণ ঘটায় তাই শিল্পজাত দূষণ নামে পরিচিত। যেমনঃ জৈব ও অজৈব পদার্থের শিল্প উৎপাদনে সর্বদা কিছু বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হয় । যেমনঃ গনিজ এসিড ও ক্ষার যেমনঃ অ্যামোনিয়া উৎপাদনকারী ও ব্যবহারকারী কারখানাগুলি থেকে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে প্রচুর পরিমাণ এসিড ও ক্ষার নদী , হ্রদ বা জলাশয়ে সরাসরি ফেলে দেওয়া হয় । উদাহরণস্বরূপ , যন্ত্র ও কাগজ শিল্পে প্রচুর পরিমাণ এসিড ও ক্ষার ব্যবহার করা হয়। ওই এসিড বা কার পানির সঙ্গে মিশে পানির অম্লত্ব বা ক্ষারকত্‌ বাড়িয়ে দেয় । আম্লিক ও ক্ষারীয় পানির প্রভাবে জলজ উদ্ভিদ , মাছ ও অন্য জলজ প্রাণীদের ( ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণুসহ ) জীবন বিপন্ন হয়। এমন পানি মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী।

৮. কৃষিজাত দূষণ ( Agriculture pollution ): কৃষিজাত দূষণ সাধারণত পেস্টিসাইড , সার , গবাদি পশুর বর্জ্যজনিত কারণে সংঘটিত হয়।


বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের প্রাকৃতিক কারণ 

১। জৈবিক কারণ: পরিবেশ দূষণের প্রধান কারণ জীবজগতের খাদ্য শৃঙ্খল বিঘ্নিত হওয়া । বিশ্বের চেনা অচেনা নানা উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে যার কারণে খাদ্য শৃঙ্খল বিঘ্নিত হচ্ছে।

২। ভৌত কারণ: আবহাওয়া , জলবায়ুর অস্বাভাবিক আচরণ- অতিবৃষ্টি , অনাবৃষ্টি , চরম তাপমাত্রা , ভূমিকম্প , বজ্রপাড় , আগ্নেয়গিরি প্রভৃতি প্রাকৃতিক পরিবেশকে দূষিত করে।

৩। মৃত্তিকাজনিত কারণ: মৃত্তিকার ক্ষয় , ভূপৃষ্ঠের ক্ষয় ও পরিবহণের মাধ্যমে পরিবেশকে নষ্ট করে।

৪। পানিচক্র: পানির অবস্থার পরিবর্তন ও অবস্থানের পরিবর্তন যথা- বরফগলা , কুয়াশা , তুষারপাত , বন্যা , খরা , আপেক্ষিক আর্দ্রতা কমবেশী হওয়া পরিবেশকে নষ্ট করে।

৫। রাসায়নিক কারণ: মাটি ও পানির অম্লত্ব ও ক্ষারত্বের আধিক্য , অম্লরস , বিষাক্ত দ্রব্যের উপস্থিতি পরিবেশ দূষণ ঘটায় । পানীয় জলে আর্সেনিক , সিসা ও ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি পরিবেশের জন্য মারাত্মক।

বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের মনুষ্যসৃষ্ট কারণ 

১। বন ধ্বংসঃ বন ধ্বংসের কারণে গাছ কর্তৃক CO2 গ্রহণ কম হচ্ছে । ফলে পরিবেশ যাত্রাতিরিকভাবে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে । 

২। কীটনাশক ব্যবহারঃ কৃষিক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে ।

৩। শিল্প স্থাপনঃ শিল্প - কলকারখানা নিঃসৃত বিষাক্ত গ্যাস ও কালো ধোঁয়া পরিবেশ দূষিত করছে । 

৪। পানিসেচ: মাত্রাতিরিক্ত পানি সেচের মাধ্যমে ব্যবহারের ফলে পানিতে আর্সেনিক ধরা পড়ছে । 

৫। ভূমি ক্ষয়: ভূমির যথেচ্ছা ব্যবহারের ফলে মাটির অণুজীব ও হিউমাস হ্রাস পেয়ে পরিবেশ দূষিত করছে।

৬। মোটরযান: বিভিন্ন প্রকার ইঞ্জিন চালিত যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাস পরিবেশ দূষিত করছে।

৭। অপাচ্য দ্রব্যঃ পলিথিন , প্লাষ্টিক , কাঁচ প্রভৃতির বহুল ব্যবহার মাটিতে সঞ্চিত হয়ে পরিবেশ দূষিত করছে । 

৮। অপরিকল্পিত নগরায়ণঃ দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে । 

৯। শব্দ দূষণঃ নগর জীবনে বিভিন্ন উৎস থেকে নির্গত সুরবর্জিত শব্দ দূষণের কারণে মানসিক ও স্নায়ুবিক অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে 

১০। তেল দূষণঃ তেলের অনিরাপদ স্থানান্তর কিংবা তেলের ট্যাংকের ছিদ্র বা সংঘর্ষের কারণে তেল সূর্যা হচ্ছে যা পরিবেশ দূষিত করছে । 

১১। পানি দূষণঃ পৌর আবর্জনা , শিল্পজাত আবর্জনা , গৃহস্থালীয় আবর্জনা ও প্রয়োকেমিক্যালস ব্যবহারের কারণে পানি দূষিত হয়ে পরিবেশ দূষণ করছে । 

১২। জনসংখ্যা বৃদ্ধিঃ অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যাবৃদ্ধি ভরির উপর , খাদ্যশস্যের উপর তথা আর্থিক বিষয়ের উপর চাপ সৃষ্টি করছে যার ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।


পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ 

পৃথিবীতে সবার বাসযোগ্য করার নিমিত্তে এ মুহূর্তে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কিছু বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত । পরিবেশ দূষণ প্রতিকারে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে-

১। জনগণকে বনায়নে উদ্বুদ্ধ করা , জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।

২। সামাজিক বনায়নের জন্য কার্যকর আইন প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন । 

৩। বিপণ্ন ও প্রায় বিলুপ্ত উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি সংরক্ষণে পদক্ষেপ গ্রহণ করা । 

৪। আবাসিক এলাকায় শিক্ষা - কারখানা স্থাপন করা যাবে না।

৫। শিল্প বলোর স্বাস্থ্যসম্মত ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা।

৬। বসতবাড়ি ও বন উন্নয়ন সাধন । 

৭। এগ্রোকেমিক্যালস এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ। 

৮। প্লাষ্টিক পলিথিন ও সিনথেটিক দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণ ও নিয়ন্ত্রণ।

৯। পাহাড়ে জুম চাষ নিরুৎসাহিত করণ। 

১০। মৃত্তিকার ক্ষয় রোধ করা।

১১। ইটভাটার কাল ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে আইন তৈরি করা।

১২। পৌর বর্জ্য দ্বারা কম্পোষ্ট সার তৈরী করা । 

১৩। বাসভবন ও খামার পদ্ধতির উন্নয়ন।

১৪। পলিথিনের পরিবর্তে পাটজাত দ্রব্যর ব্যবহার করণ।

১৫। জৈব কৃষি খামারের প্রসারে উৎসাহিতকরণ । 

১৬। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সারের ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ । 

১৭। ভেজাল নিয়ন্ত্রণে বিএসটিআই এর কার্যাবলি ফলপ্রসু ও জোরদার করণ।

১৮ । নিয়মিত নদী - নালা খনন ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা । 

১৯। জ্বালানীর মান ও যানবাহনের ক্ষতিকর কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ । 

২০। ভূগর্ভস্থ পানি , গ্যাস , আকরিক ও বনজ সম্পদের ব্যবহারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন।

২১। মৃত্তিকা স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।

২২। শব্দ দূষণ রোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা । 

২৩। পানি নিষ্কাশনের জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ । 

২৪। সর্বোপরি পরিবেশ দূষণের কুফল সম্বন্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url