চাহিদার নির্ধারক || Determinants of Demand
চাহিদার নির্ধারক
একজন ক্রেতা কোনো দ্রব্য কী পরিমাণ ক্রয় করবে তা কতকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। এ বিষয়গুলোকে চাহিদার নির্ধারক বলে। অর্থাৎ যেসব বিষয় বা অবস্থা একটি দ্রব্যের চাহিদাকে প্রভাবিত করে , সেগুলোকে একত্রে চাহিদার নির্ধারক বলে। নিচে চাহিদার নির্ধারকসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. দ্রব্যের দাম: দ্রব্যের দামের ওপর তার চাহিদা বহুলাংশে নির্ভর করে । দ্রব্যের দাম কমলে সাধারণত চাহিদা বাড়ে এবং দাম বাড়লে চাহিদা কমে। এটি চাহিদা নির্ধারণের মূখ্য উপাদান হিসেবে কাজ করে।
২. বিকল্প দ্রব্যের দাম : বিকল্প দ্রব্যের দাম চাহিদাকে প্রভাবিত করে । যেমন- গুড় ও চিনির ক্ষেত্রে গুড়ের দাম কমে গেলে লোকজন চিনির পরিবর্তে গুড় বেশি ক্রয় করে বলে চিনির চাহিদা কমে যায়। একইভাবে মাছের দাম বাড়লে মাংসের চাহিদা বাড়ে ।
৩. পরিপূরক দ্রব্যের দাম : কোনো দ্রব্যের পরিপূরক দ্রব্যের দাম পরিবর্তিত হলে তার চাহিদাও পরিবর্তিত হয়। যেমন— গাড়ি ও পেট্রোলের ক্ষেত্রে পেট্রোলের দাম বাড়লে, গাড়ির চাহিদা কমে । আবার কলমের দাম বাড়লে, কালির চাহিদা কমে যায়।
৪. ভোক্তার রুচি ও অভ্যাস: ভোক্তার রুচি ও অভ্যাস পরিবর্তিত হলে চাহিদা প্রভাবিত হয়। কোনো কারণে রুচির পরিবর্তন ঘটলে, আলোচ্য দ্রব্যটি ভোক্তার কাছে বেশি পছন্দনীয় হয়ে উঠলে তার চাহিদা বাড়ে। তখন দামের বিষয়টি খুব গুরুত্ব দেওয়া হয় না ।
৫. ক্রেতার আয়: চাহিদা নির্ধারণকারী বিষয়গুলোর মধ্যে আয় অন্যতম। আয় বাড়লে ক্রেতার চাহিদা বাড়ে এবং আয় কমলে চাহিদা কমে।
৬. জনসংখ্যার পরিবর্তন : দেশে জনসংখ্যা বাড়লে ক্রেতার সংখ্যা বাড়ে। ফলে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির চাহিদা বাড়ে।
৭. ঋতুর পরিবর্তন: ঋতু পরিবর্তনের ফলে চাহিদা প্রভাবিত হয়। গরমের দিনে বৈদ্যুতিক পাখা, পাতলা কাপড়, ঠাণ্ডা পানীয় এবং শীতের দিনে গরম কাপড়, লেপ, তোশকের চাহিদা বাড়ে।
৮. সম্পদ বণ্টনের পরিবর্তন: সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা চাহিদাকে প্রভাবিত করে। সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন হলে মৌলিক ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর চাহিদা বাড়ে। ফলে সুষম বণ্টনে চাহিদা বাড়ে এবং অসম বণ্টনে চাহিদা কমে।
৯. সঞ্চয়: সঞ্চয় প্রবণতার পরিবর্তন হলে চাহিদা প্রভাবিত হয়। সঞ্চয় প্রবণতা বাড়লে জনগণের কেনার ইচ্ছা কমে যায়। ফলে চাহিদাও কমে যায়।
১০. জীবনযাত্রার মান: দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হলে বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য ও বিলাসবহুল দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়।
১১. ব্যবসায় তেজী ও মন্দাভাব: ব্যবসায়ে তেজীভাব থাকলে সমাজের সকল স্তরের লোকের আয় ও চাহিদা বাড়ে এবং মন্দাভাব দেখা দিলে লোকের আয় ও চাহিদা হ্রাস পায়।
১২ . নগদ প্রিয়তার পরিবর্তন: জনসাধারণের নগদ প্রিয়তার হ্রাসবৃদ্ধির সাথে সাথে দ্রব্যের চাহিদার তারতম্য ঘটে। নগদ প্রিয়তা বাড়লে ভোগ ব্যয় তথ্য চাহিদা হ্রাস পায় এবং নগদ প্রিয়তা কমলে চাহিদা বৃদ্ধি পায়।
১৩. দামের ভবিষ্যৎ গতি: ভবিষ্যতে দ্রব্যটির দাম আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে প্রাথমিক পর্যায়ে বর্ধিত দামেও চাহিদা বাড়বে এবং দাম কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে চাহিদা কমে যাবে।
ছাড়াও অর্থের যোগানের পরিবর্তন, নতুন দ্রব্যের উদ্ভাবন, ব্যবসায়ের তেজি বা মন্দা ভাব, আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ইত্যাদি চাহিদাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।
চাহিদা রেখা ডানদিকে নিম্নগামী হওয়ার কারণ
চাহিদা রেখা বামদিক থেকে ডানদিকে নিম্নগামী হওয়ার মূল কারণ হলো চাহিদা বাধ। চাহিদা বিধিতে অন্যান্য অবস্থা স্থির থেকে; দ্রব্য ও সেবার দামের সাথে চাহিদার পরিমাণের বিপরীত সম্পর্ক নির্দেশ করে। এ সম্পর্কের কারণেই চাহিদা রেখা বাম থেকে ডানদিকে নিম্নগামী হয়। তবে এ সম্পর্কে যেসব কারণ রয়েছে, তা হলো:
১. ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধি: এ বিধি অনুযায়ী কোনো দ্রব্যের ভোগ বাড়লে ভোক্তার নিকট তার প্রান্তিক উপযোগ কমতে থাকে এবং এক পর্যায়ে দ্রব্যটির প্রান্তিক উপযোগ দামের সমান হয়। অর্থাৎ দ্রব্যের প্রান্তিক উপযোগ বা দাম হ্রাস পাওয়ার কারণে তার ভোগ বা চাহিদা বাড়ে। আবার দাম বা প্রান্তিক উপযোগ বেশি হলে দ্রব্যের ভোগ বা চাহিদা কম হয়। এজন্য চাহিদা রেখা ডানে নিম্নগামী হয়।
২. আয় প্রভাব: দ্রব্যের দাম কমলে ক্রেতা একই পরিমাণ দ্রব্য ক্রয়ের জন্য আগের চেয়ে কম অর্থ ব্যয় করে। ফলে ক্রেতা তার উদ্বৃত্ত অর্থ দ্বারা অতিরিক্ত দ্রব্য ক্রয় করে। পক্ষান্তরে, দাম বাড়লে ক্রেতার প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় তার চাহিদাও কমে যায়।
৩. পরিবর্তক প্রভাব: ধরি, গুড় ও চিনি দুটি পরিবর্তক দ্রব্য। গুড়ের দাম কমে গেলে ক্রেতা চিনির পরিবর্তে গুড় বেশি ক্রয় করে। এর ফলে সম্ভা পণ্যটির চাহিদা বাড়ে। এজন্য দ্রব্যের দাম ও চাহিদার মধ্যে যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তা নিম্নগামী চাহিদা রেখার দ্বারাই প্রকাশ পায়।
৪. ক্রয়ক্ষমতা বা সামর্থ্য: কোনো দ্রব্যের দাম বাড়লে তা অনেক ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। ফলে তার সামগ্রিক চাহিদা কমে। আবার দাম কমলে অনেক ক্রেতা সেটি ক্রয় করতে সমর্থ হয়। এভাবে দাম ও চাহিদার বিপরীতমুখী সম্পর্ক দেখা যায়— যা নিম্নগামী চাহিদা রেখার দ্বারা প্রকাশ হয়।
৫. ঢাল ঋণাত্মক: চাহিদা রেখার ঢাল ঋণাত্মক; ফলে দাম ও চাহিদার পরিমাণের মধ্যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক বিদ্যমান। যেমন— কোনো দ্রব্যের দাম 2 টাকা থেকে 4 টাকায় বৃদ্ধি পেলে, চাহিদার পরিমাণ ৪ একক থেকে হ্রাস পেয়ে 6 একক হলো।
চাহিদা সূচি ও চাহিদা রেখার মধ্যে তুলনা
চাহিদা বিধি থেকে চাহিদা অপেক্ষক তথা চাহিদা সমীকরণ পাওয়া যায়। চাহিদা সমীকরণ থেকে চাহিদা সূচি তৈরি হয়। চাহিদা সূচি থেকে চাহিদা রেখা পাওয়া যায়। সুতরাং, চাহিদা সূচি এবং চাহিদা রেখা উভয়ই চাহিদা বিধির বহিঃপ্রকাশ । এদের মধ্যে পদ্ধতিগত তুলনা নিচে তুলে ধরা হলো:
১. সংজ্ঞাগত: অন্যান্য অবস্থা স্থির থেকে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে , বিভিন্ন দামে একটি দ্রব্যের চাহিদার পরিমাণ যে তালিকায় দেখানো হয় সেটিকে চাহিদা সূচি বলে। অন্যদিকে , অন্যান্য অবস্থা স্থির থেকে , একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন দামে একটি দ্রব্যের চাহিদার পরিমাণ যে রেখাচিত্রের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়, সেটিকে চাহিদা রেখা বলে।
২. প্ৰকাশগত: চাহিদা বিধির গাণিতিক প্রকাশই হলো চাহিদা সূচি। আবার , চাহিদা বিধির জ্যামিতিক প্রকাশই হলো চাহিদা রেখা।
৩. নির্ভরশীলতা: চাহিদা সূচি, চাহিদা অপেক্ষকের ওপর নির্ভরশীল। চাহিদা রেখা , চাহিদা সমীকরণের ওপর নির্ভরশীল।
৪. উপস্থাপন পদ্ধতিগত: চাহিদা সূচিতে সাধারণত বামদিকে দাম এবং ডানদিকে চাহিদার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়। চাহিদা রেখায় X বা ভূমি অক্ষে চাহিদার পরিমাণ (Q) এবং Y বা লম্ব অক্ষে দাম (P) নির্দেশ করা হয়।
সুতরাং, বলা যায় চাহিদা সূচির জ্যামিতিক প্রকাশই হলো চাহিদা রেখা- যা চাহিদা বিধির একই তথ্য প্রকাশের দুটি কৌশল আলোচনা করে থাকে।