হিজরত || Hijrat

 

হিজরত
ব্যঙ্গ - বিদ্রূপ, অত্যাচার ও প্রলোভন কোনো পন্থাতেই যখন তারা হযরত মুহাম্মদ (স) -কে ইসলাম প্রচার থেকে বিরত করতে পারলো না এবং তার উপর যখন কুরাইশগণ জানতে পারলো যে, শত্রুভাবাপন্ন দেশ মদিনায় তাঁর আশ্রয়স্থল স্থির হয়েছে, তখন তারা মন্ত্রণাগৃহে মিলিত হয়ে আবু জেহেলের প্রস্তাবে হযরত মুহাম্মদ (স:) -কে হত্যা করতে মনস্থ করলো। ইতোমধ্যে আবিসিনিয়া হতে প্রত্যাগত ২০০ জন মুসলমানকে এবং অন্য সব মুসলমানকে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনায় পাঠিয়ে দিলেন। শুধু স্বয়ং তিনি, আবুবকর (রা:) এবং আলী (রা) মক্কায় থাকেন। কাফেরগণ অন্যদিকে যাতে তাঁকে হত্যার রক্তদণ্ড দিতে না হয় সেজন্য মক্কার সব গোত্রের ভেতর হতে প্রতিনিধি নিয়ে একদল অস্ত্রধারী যুবককে আবু জেহেলের নেতৃত্বে হযরতকে হত্যা করার জন্য পাঠায়। আল্লাহর প্রত্যাদেশ পেয়ে এবং এই ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে জানতে পেরে হযরত (স:) আবুবকরকে (রা) সাথে নিয়ে দুটি উটের পিঠে উপবিষ্ট হয়ে মদিনাভিমুখে রওয়ানা হলেন। রাসুলুল্লাহ (স) -এর বিছানায় আলীকে (রা) শোয়ায়ে রাখা হয়েছিল।

মক্কা হতে মদিনার দূরত্ব প্রায় ২৫০ মাইল। কুরাইশগণ এটা জানতে পেরে তাঁদের পশ্চাদ্ধাবন করলে তিনি আবু বকরসহ পথিমধ্যে ‘সওর’ নামক পর্বত গুহায় আত্মগোপন করে তথায় তিন দিন অবস্থান করেন। চতুর্থ দিনে তাঁরা গিরিগুহা হতে বের হয়ে মদিনাভিমুখে যাত্রা করেন। পথের মধ্যে আরও অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে তাঁরা ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ২৪ শে সেপ্টেম্বর (১২ ই রবিউল আউয়াল) তারিখে মদিনার নিকটবর্তী কুবা নামক মরূদ্যানে এসে পৌঁছেন। পরে আলী (রা) সেখানে তাঁদের সাথে মিলিত হন। মক্কা হতে মদিনায় হযরত মুহাম্মদ (স) -এর সুপরিকল্পিত প্রত্থানকে ইতিহাসে হিজরত বলা হয়। তাঁর এই হিজরতকে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করার জন্য ১৭ বছর পর হযরত ওমর (রা) চান্দ্র বছরের প্রথম মাস মহররমের প্রথম দিন (১৬ ই জুলাই) হতে হিজরী সালের প্রবর্তন করেন।
জোসেফ হেল যথার্থ বলেন— “হিজরত, মহানবি (স) জীবনের পরিবর্তনকারী সীমা।” 

কোনো কোনো ইউরোপীয় ঐতিহাসিক এ ঘটনাকে মদিনায় “পলায়ন হিসেবে বিবেচনা করেছেন। আসলে এটি ছিল মানব জাতির ও ধর্মের বৃহত্তর স্বার্থে সুপরিকল্পিত গমন।


হযরত মুহাম্মদ (স:)-এর মদিনায় হিজরতের কারণ 
হযরতের নবুয়ত প্রাপ্তির দীর্ঘ ১২ বছর পর তিনি মক্কা হতে মদিনায় হিজরত করেন। কেবল নির্যাতন এবং মৃত্যুর ভয়ে যে তিনি আপন প্রিয় মাতৃভূমিকে পরিত্যাগ করেছিলেন তা ঠিক নয়। কারণ নির্যাতন ও মৃত্যুকে জগতের কোনো মহাপুরুষই কখনও ভয় করেন নি। সত্যের ডাকে এবং কর্তব্যের খাতিরেই তাঁকে মূলত হিজরত করতে হয়েছিল। হিজরতের প্রধান কারণগুলো নিচে আলোচনা করা হলো: 
১. ভৌগোলিক কারণ: শুষ্ক জলবায়ু এবং উষ্ণ আবহাওয়ার জন্য মক্কাবাসিগণ ছিল রুক্ষ এবং বদমেজাজী। অভাবের জন্য কোনো কিছু গভীরভাবে চিন্তা করার অবকাশও তাদের ছিল না, শক্তিও ছিল না। অপরপক্ষে শস্যশ্যামল মদিনাবাসিগণ সুরুচিসম্পন্ন এবং চিন্তাশীল ছিলেন। তাঁদের ভালো - মন্দ বিচার করার ক্ষমতা ছিল।

২. মনস্তাত্ত্বিক কারণ: পৃথিবীর ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যে, কোনো নবি বা মনীষী প্রথমদিকে তাদের স্বদেশবাসী কর্তৃক সম্মানিত হননি। হযরতকেও (স) যথাযোগ্য স্থান এবং সম্মান মক্কাবাসিগণ দেয়নি। তার শুধু তাঁকে উপহাস করেছে এবং লাঞ্ছিত করেছে। কিন্তু মদিনাবাসিগণ তাঁকে এবং তাঁর সত্য ও শান্তির ধর্মকে সাদরে গ্রহণ করেন।

৩. কুরাইশদের স্বার্থে আঘাত: মক্কার স্বার্থপর পুরোহিত শ্রেণি এবং আভিজাত্যাভিমানী কুরাইশগণ প্রথম হতেই ইসলাম প্রচারের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পুতুল পূজার অবসান হয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের অর্থোপার্জনের পথ, সামাজিক মর্যাদা এবং রাজনৈতিক প্রভুত্ব সবই শেষ হয়ে যাবে, সেজন্য কুরাইশকুল মরিয়া হয়ে হযরতের (স) বিরোধিতা করে। অপরপক্ষে মদিনায় ঐরূপ কোনো অভিজাত সম্প্রদায় না থাকায় সেখানে নবির (স) বসবাস এবং ধর্মপ্রচার উভয়ই সম্ভবপর এবং সহজতর হবে বলে স্বাভাবিকভাবেই বিবেচনা করা হয়েছিল।

৪. আউস ও খাযরাজ সম্প্রদায়ের আমন্ত্রণ: ঐতিহাসিক ওয়াটের মতে, “হিযরত অর্থ মুহাম্মদকে (সা) মদিনাবাসী ধর্মের দিক দিয়ে নবি হিসেবে এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে তাদের বিবদমান গোত্রগুলোর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

মদিনায় বিভিন্ন জাতির বিশেষ করে আউস ও খাযরাজ গোত্র দুটি বুয়াস 'নামে এক রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ যুদ্ধে কয়েক যুগ ধরে লিপ্ত ছিল। ফলে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছিল এবং জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে মধ্যপ্রতা এবং শান্তি স্থাপনের জন্য একজন নিরপেক্ষ ন্যায়নিষ্ঠ এবং আধ্যাত্মিক পরিচালকের প্রয়োজন ছিল। হযরতের (স) অসাধারণ ব্যক্তিত্বের পরিচয় পেয়ে তাঁকে মদিনাবাসী আমন্ত্রণ জানালে তিনি মদিনায় হিজরত করেন।

৫. আত্মীয়তার সম্পর্ক: মাতৃকূলের দিক দিয়ে মদিনাবাসিগণ হযরতের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিল। তাঁর পিতা আবদুল্লাহ এবং প্রপিতামহ হাশিম মদিনাতে বিবাহ করেছিলেন। এ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার জন্য মুহাম্মদ (স) মদিনাবাসীদের সহৃদয়তা ও সহযোগিতা পাবেন বলে আশা করেছিলেন। ইতোপূর্বে ফুফাত ভাই যোহায়েরের উদ্যোগ ও নেতৃত্বে কুরাইশদের বয়কট নীতি প্রত্যাহৃত হয়েছিল। সুতরাং এমন আশা পোষণ করা অযৌক্তিক ছিল না।

৬. ইহুদিদের আগ্রহ: মদিনায় বসবাসকারী ইহুদি সম্প্রদায় তাদের ধর্মগ্রন্থ, আসমানী কেতার ভৌরাতে শেষ নবির আবির্ভাব সম্বন্ধে অবগত ছিল। কাজেই মুহাম্মদকে (স) প্রতিশ্রুত নবি হিসেবে তাদের মধ্যে মদিনায় পাবার জন্য তারা সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল। হিজরতের পূর্বে এরূপে মদিনায় তাঁর আশ্রয়স্থল এবং কর্মল প্রস্তুত হয়েছিল।

৭. ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের ব্যর্থতা: রাসুলুল্লাহ (স) -এর মদিনায় হিজরতের পূর্বে বিভ্রান্ত ইহুদি ধর্ম এবং বিকৃত ও দুর্নীতিগ্রস্ত খ্রিস্টান ধর্ম মদিনায় প্রচলিত ছিল। যদিনাবাসীর নৈতিক চরিত্রের উপর উভয় ধর্মই কোনোরূপ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় নি। ইসলাম ধর্ম তাদের আধ্যাত্মিক ক্ষুধা মিটাতে সম্পূর্ণভাবে সক্ষম হবে মনে করে মদিনাবাসিগণ মহানবিকে (স) তাদের দেশে গ্রহণ করেছিল এবং সহজেই তারা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিল।

৮. মুসাবের অনুকূল রিপোর্ট: মুহাম্মদ (স) মুসার নামক একজন বিশ্বস্ত ধর্মভীরু অনুসারীকে তাঁর হিজরতের এক বছর পূর্বে মদিনায় ধর্ম প্রচারের জন্য পাঠিয়েছিলেন। মদিনাবাসিগণের মনোভাব ইসলাম ধর্মের অনুকূল বলে তিনি হযরতকে জানান। মদিনায় ধর্ম প্রচার সহজতর হবে মনে করে তিনি তথায় হিজরত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।

৯. আবু তালিব ও খাদিজার ইন্তেকাল: বিপদে রক্ষক পিতৃব্য আবু তালিব এবং চিরসঙ্গিনী খাদিজার (রা) মৃত্যুতে হযরত অত্যন্ত নিঃসহায় হয়ে পড়েন। কুরাইশগণ তখন তাকে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত হলো। তাঁর উপর এবং তাঁর অনুসারীদের উপর কুরাইশদের নির্যাতন শতগুণে বৃদ্ধি পেল। মক্কাবাসীদের জঘন্য শত্রুতা হযরতের মদিনায় হিজরত করার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

১০. মুদারী ও হিয়ারী সংঘর্ষ: মুদারী - হিমারী অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ আরবের লোকদের বংশগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ঘোর বিদ্বেষ হিজরতের প্রধানতম সহায়ক কারণ ছিল। মদিনার আউস ও খাযরাজ গোত্র দুটি ছিল দক্ষিণ আরবের হিমার বংশোদ্ভূত। মুদার বংশের অন্তর্ভুক্ত মক্কাবাসী কুরাইশরা ছিল তাদের জাত শত্রু। এ অবস্থায় মক্কার অবাঞ্ছিত ব্যক্তি (Persona non grata) মুহাম্মদ (স) -কে সাদরে গ্রহণ করতে তারা দ্বিধাবোধ করেনি। মুহাম্মদ (স) নিরাপদ আশ্রয়ের নিশ্চয়তা লাভ করলেন। 

তদুপরি, ব্যবসায়ী মক্কার মুসলমানগণ মদিনার নিরাপদ অবস্থান হতে সিরিয়ার সাথে বাণিজ্য করে জীবিকা উপার্জন করতেও পারবে। পরনির্ভর উদ্বাস্তু জীবন - যাপন করতে হবে না এ বিবেচনাও কার্যকর ছিল।

১১. ঐশী প্রত্যাদেশ লাভ: অবশেষে , বিপদ যখন চরম আকার ধারণ করে এবং হযরত নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিলেন ঠিক সে সময় তিনি মদিনায় হিজরত করার জন্য আল্লাহর নির্দেশ লাভ করেন। তাই মুহাম্মদ (স) নিজের জীবন এবং ইসলাম ধর্ম রক্ষার্থে আল্লাহর আদেশে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে (৪ঠা রবিউল আউয়াল) মক্কা হতে মদিনায় হিজরত করেন।

হযরত মুহাম্মদ (স:)-এর মদিনায় হিজরতের গুরুত্ব
ইসলামের ইতিহাস এবং হযরত মুহাম্মদের (স) জীবনে হিজরতের গুরুত্ব অপরিসীম। 
ঐতিহাসিক অধ্যাপক হিটি - “হিজরতের সাথে সাথে (হযরতের) মক্কা জীবনের অবসান এবং মদিনা জীবনের সূচনা হয় এবং এখানেই মুহাম্মদের (স) জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তাঁর জন্মভূমি শহর তাঁকে অবহেলিত নবি হিসেবে পরিত্যাগ করে, অথচ তাঁর গ্রহণকারী নতুন শহর তাকে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বরণ করে নেয়।
হিজরতের পর হযরতের (স) পরিহাস, নির্যাতন ও নিরাশার দিনগুলোর অবসান ঘটে এবং তাঁর জীবনে দেখা দিল আশা ও ধারাবাহিক সফলতা। ইয়াসরিববাসী মহানবিকে মহা সম্মানের সাথে গ্রহণ করে। তথায় ইসলাম দ্রুত গতিতে প্রসার লাভ করে এবং অল্প সময়ের মধ্যে সমগ্র আরব জাহান মুসলমানদের অধীনে আসে।
ইয়াসরিববাসিগণ বহুদিনের শত্রুতা ও ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন। ইয়াসরিবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সভাপতি নিযুক্ত হন। ধর্মগুরুর ভূমিকা ছাড়াও তখন তিনি কূটনীতিবিদ, রাজনৈতিক নেতা এবং শাসকের ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং সর্বক্ষেত্রেই তাঁর কর্তব্য অতীব সুচারুরূপে সম্পন্ন করে তিনি বিশ্বের ইতিহাসকে নতুনভাবে প্রভাবান্বিত করেছেন। 

ইয়াসরিববাসিগণ তাঁর সম্মানার্থে তাদের নগরীর নাম রাখেন— ‘মদিনাতুন্নবি’ বা নবির নগর। শহরটি সংক্ষেপে মদিনা নামে পরিচিত হয়। হযরতের মদিনায় আগমনের সাথে সাথেই মদিনার মান, মর্যাদা, গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব বহুগুণে বেড়ে যায়। তাঁর হিজরতকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা) মদিনানবি হিজরী সালের প্রবর্তন করেন। মহানবির হিজরত ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
ঐতিহাসিক জোসেফ হেল যথার্থই বলেন — "হিজরত ইসলামের ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী একটি বিখ্যাত ঘটনা।”  
ধর্ম প্রচারের সাথে সাথে হযরত মুহাম্মদ (স) এখন একটি গোত্রনিরপেক্ষ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url