গ্রিক সভ্যতা || Greek civilization

গ্রিক সভ্যতা
গ্রিক সভ্যতার ধারণা

 
জে, ই, সোয়াইন বলেন , প্রাথমিক যুগের গ্রিকগণ তাদের দেশকে ‘গ্রিস অথবা হেলাস’ নামে অভিহিত করতো। ইউরোপের মূল ভূখণ্ড থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এ উপদ্বীপটি প্রায় ২৫,০০০ বর্গমাইলবিশিষ্ট একটি দেশ। বিশ্ববিজয়ী অপরাজেয় শক্তির অধিকারী মহাবীর আলেকজান্ডারের দেশ, বিশ্ববিশ্রুত দার্শনিক সক্রেটিস, এ্যারিস্টোটল ও প্লেটোর দেশ, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হেরোডোটাস, অসাধারণ বিজ্ঞানী পিথাগোরাস, আর্কিমিডিস, ইউক্লিড, হিপোক্রেট্স্ প্রমুখের দেশ গ্রিস জ্ঞান - বিজ্ঞান, শিক্ষা - সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। বিশ্বজগৎ যখন সভ্যতার দিকে হাঁটি হাঁটি করছিল, গ্রিক জাতি তখন জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে চারদিক আলোকিত করছিল। প্রয়োজনীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে গ্রিস তার কৃতিত্ব সংযোজন করে। তাই বিশ্বসভ্যতা গ্রিকদের কাছে বহু দিক দিয়ে ঋণী। বিশ্ববিশ্রুত কবি শেলী যথার্থভাবেই বলেন, “আমরা সবাই গ্রিক, আমাদের আমাদের সাহিত্য, আমাদের কলা— এগুলোর (সকলের) মূল রয়েছে গ্রিসে।


গ্রিক সভ্যতার আইন, গ্রিক নগররাষ্ট্র
প্রবাদ রয়েছে যে , গ্রিকরা হেলেন নামক একজন পূর্বপুরুষের বংশধর বলে নিজেদেরকে হেলেনিজ ও নিজেদের দেশকে হেলাস বলতো। গ্রিস ও গ্রিক নামটি পরে রোমানগণ দিয়েছিল। প্রাচীনকালে গ্রিস এক দেশ হলেও এক রাষ্ট্র ছিল না। তখন এখানে অনেক স্বাধীন নগররাষ্ট্র গড়ে ওঠে। গ্রিসের ইতিহাস বলতে এসব নগররাষ্ট্রের পৃথক পৃথক কাহিনীকে বুঝায়। প্রাচীন গ্রিসের প্রধান প্রধান নগররাষ্ট্রের মধ্যে এথেন্স , স্পার্টা, করিন্ধ, থিরেস, আরগস, মেসিডন প্রভৃতি নগর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ক্লাসিক্যাল গ্রিকদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অবদান হচ্ছে নগররাষ্ট্র সম্পর্কে ধ্যান - ধারণা প্রদান। দেশের ভূপ্রকৃতি ও জাতিগত বৈশিষ্ট্যের ফলে গ্লিসে নগর রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। প্রত্যেকটি নগররাষ্ট্র নিরাপত্তার জন্য প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। প্রত্যেকটি নগররাষ্ট্রের নিজস্ব সরকার , নিজস্ব দেব - দেবী, নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব এবং নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যবোধ ছিল। প্রায় প্রত্যেকটি রাষ্ট্রে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, কাউন্সিল এবং জনগণের সভার জন্য নির্দিষ্ট স্থান ছিল। কাউন্সিলের সদস্যগণ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হতেন। স্বল্প নগররাষ্ট্রে রাজতন্ত্র বিদ্যমান ছিল এবং এরূপ রাষ্ট্রের কাউন্সিল অভিজাত সম্প্রদায় দ্বারা গঠিত হতো।


গ্রিক নগররাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১. গ্রিক নগররাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য ছিল আয়তনে ছোট অর্থাৎ ১০০ বর্গমাইলের মধ্যে। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ রাষ্ট্র ছিল পাহাড় -পর্বত দ্বারা বেষ্টিত। রাষ্ট্রগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে আড্রিয়াটিক সাগর, ভূমধ্যসাগর ও ইন্ডিয়ান সাগর।

২. এ সকল নগররাষ্ট্রের লোকসংখ্যা ছিল সীমিত। ১০-১৫ হাজার থেকে ৬০-৭০ হাজার। স্পার্টার পরিধি ছিল চার হাজার বর্গমাইল। এথেন্সের এক হাজার বর্গমাইল। এ উভয় নগররাষ্ট্রের লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লক্ষ।
৩. প্রতিটি নবপ্রতিষ্ঠিত উপনিবেশই ছিল এক একটি স্বতন্ত্র নগররাষ্ট্র। গ্রিসে নগররাষ্ট্রের উদ্যোগেই নতুন উপনিবেশ স্থাপিত হতো । এ প্রক্রিয়ায় বিশিষ্ট গ্রিক সংস্কৃতি অর্থাৎ বিশেষ ধরনের গ্রিসীয় জীবনযাত্রা, চিন্তাধারা, ভাব ভাষা ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে সকল গ্রিক নগররাষ্ট্রে বিস্তার লাভ করে।

৪. গ্রিক নগররাষ্ট্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জমির অভাব দেখা দেয়ায় গ্রিকরা দলে দলে নতুন স্থানে গিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। এ ছাড়া ব্যবসায় - বাণিজ্যের বিস্তারের প্রয়োজনেও নতুন নতুন স্থানে উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছিল। এভাবে ইজিয়ান সাগরের বিভিন্ন দ্বীপে অজস্র গ্রিক নগররাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। নতুন উপনিবেশ স্থাপনের সময় গ্রিকরা দলে দলে নৌকাযোগে কৃষক, কারিগর, বণিক প্রভৃতি পেশার স্থানীয় অধিবাসীদের পরাজিত করে দাসে পরিণত করতো।

৫. গ্রিক নগররাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব - কলহে অহরহ লিপ্ত থাকা। কিন্তু বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে গ্রিকরা একত্রিতভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে । সকল নগররাষ্ট্রে প্রথমদিকে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ ও চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিসের প্রায় সব নগর রাষ্ট্রেই জনসাধারণের শাসন অথবা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

৬. খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে আইনশাস্ত্রবিদ শাইফারগণ স্পার্টার গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। স্পার্টা ছিল উর্বর ভূমির দেশ। এ অঞ্চলটি পশুচারণের জন্যও উপযোগী ছিল। গণতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতি সেখানে প্রবর্তিত হয়নি। সেখানকার শাসনব্যবস্থা ছিল স্বৈরাচারী ও একনায়কত্বমূলক । সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তারা তেমন অবদান রাখতে সক্ষম হয়নি। তবে শরীরচর্চা ও খেলাধুলায় তারা বেশ পারদর্শী ছিল। সেখানকার অধিবাসীবৃন্দ বিদেশে ভ্রমণ কিংবা বৈদেশিক ব্যবসায় বাণিজ্য পরিচালনার অনুমতি পেত না। গুপ্ত ও প্রকাশ্য করের সাহায্যে রাষ্ট্রের কার্যাবলি ও চিন্তাধারা নিয়ন্ত্রিত হতো।

৭. স্পার্টার শাসন পরিচালনা করতেন দু'জন রাজা, একটি অভিজাত পরিষদ ও একটি সাধারণ পরিষদ।

৮. স্পার্টার নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি নাগরিককে তার সন্তান ৭ বছর বয়সে পদার্পণ করলে তাকে সামরিক শিবিরে রেখে আসতে হতো এবং ২০ বছর বয়স পর্যন্ত তাকে সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হতো। দুর্বল শিশু জন্মলাভ করলে তাকে পাহাড়ের চূড়ায় ফেলে আসতে হতো। নতুবা তাকে দাসে পরিণত করা হতো। জনৈক ঐতিহাসিক বলেন, “স্পার্টা মূলত একটি সামরিক রাষ্ট্র ছিল।”

৯. পারসিকদেরকে পরাজিত করে এথেন্সবাসীর গৌরব বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল। এ নগররাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করত পাঁচ শ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি কাউন্সিল। সেনাপতি নির্বাচিত হতেন এর প্রধানই। এভাবেই পেরিকেলস্ খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ অব্দে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন । তাঁর আমলেই এথেন্স গৌরবের চরম শিখরে আরোহণ করে। সে দেশে বিদ্যমান জনগণের সংসদ সকল প্রকার প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদেরকে নিয়োগ এবং চাকরিচ্যুত করতে পারতো। গোপন ব্যালট ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত ৫০০ জন নাগরিক জুরি হিসেবে বিচারকার্য সমাধা করতেন। এভাবে লক্ষ করা যায় যে , এথেন্সে সে যুগে পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত ছিল। ফিনিসীয়দের ন্যায় তারা উপনিবেশ স্থাপন করে কৃষ্ণ সাগর, দক্ষিণ এশিয়া মাইনর , দক্ষিণ ইটালি এবং সিসিলীতে ব্যবসা - বাণিজ্য পরিচালনা করতো।

১০. গ্রিক নগররাষ্ট্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো জাতীয় ঐক্য রক্ষার জন্য অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ। এভাবে সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে অলিম্পিকের সূত্রপাত ঘটেছিল। মুষ্টিযুদ্ধ , ঘোড়দৌড়, ম্যারাথন দৌড়, উচ্চ লম্ফ, দীর্ঘ লম্ফ ইত্যাদি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো।


গ্রিক নগররাষ্ট্রের পতনের কারণসমূহ:
১. স্বৈরাচারী ও গণতান্ত্রিক মতবাদ নিয়ে প্রত্যেক নগররাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদ ও সংঘর্ষ লেগেই থাকতো । এর ফলে এগুলো নগররাষ্ট্র পতনের দিকে ধাবিত হয়।

২. অভ্যন্তরীণ অনৈক্য ও দুর্বলতাও পতনের আর একটি কারণ ছিল।

৩. রোমের অভ্যুত্থানের সময় এ সকল নগররাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদ - বিসম্বাদ চরম আকার ধারণ করে । এর ফলে শক্তিশালী রোমানরা গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলো অধিকার করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়।

৪. এথেন্সের পতনের পর প্রধান শত্রু পারস্যের সাহায্যে স্পার্টা কিছুকালের জন্য স্বীয় প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু নিজের সংকীর্ণতা , প্রাদেশিকতা ও সাম্রাজ্যের অন্তর্গত দেশগুলোর প্রতি অত্যাচারের ফলে স্পার্টা বেশি দিন তার আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়নি।

৫. থিস ও তার সুযোগ্য নেতা ইপামেননদাসের মৃত্যুর (খ্রিস্টপূর্ব ৩৬২ অব্দ) পর শিগগিরই তার শ্রেষ্ঠত্ব হারিয়ে ফেলে পতনের অতল সাগরে ডুবে যায়।

৬. বহিঃশত্রুর বিশেষ করে পারস্য ও মেসিডোনিয়ার আক্রমণের ফলে গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোর দ্রুত পতন সাধিত হয়।

অতঃপর অপরাজেয় ও অপ্রতিরোধ্য দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের আবির্ভাবের ফলে গ্রিক নগররাষ্ট্রসমূহের কবর রচিত হয়। তবে আলেকজান্ডারের আবির্ভাবের ফলে গ্রিক সভ্যতার সাথে নিকট প্রাচ্যের সকল সভ্যতার সমন্বয় সাধিত হলে হেলেনেস্টিক যুগের ও হেলেনিক সভ্যতার উদ্ভব ঘটে। আলেকজান্ডারের তৎকালীন পশ্চিম বিশ্বের সমগ্র সভ্য দেশগুলো অধিকারের ফলে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। এর ফলে একটি বিশ্ববাজার (পশ্চিম আফ্রিকা থেকে মধ্য এশিয়া, ভারত, আলেকজান্দ্রিয়া, এন্টিয়ক ও রোডস পর্যন্ত বিস্তৃত) গঠিত হয়েছিল।


গ্রিক সভ্যতার শিল্পকলা ও স্থাপত্য শিল্প
গ্রিকগণ শিল্পকলার ক্ষেত্রে আর্কেয়িক, হেলেনিক এবং হেলেনেস্টিক শিল্পকলা গ্রহণ করেছিল। এ শিল্পকলা গ্রিক এবং নিকট প্রাচ্যের অন্যান্য জাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল। গ্রিকগণ ধর্ম সম্পর্কীয় গান রচনা করতো। এক্ষেত্রে মহাকবি হোমারের অবদান অনস্বীকার্য। তারা বাঁশি বাজানো জানতো এবং বিভিন্ন প্রকার বাদ্যযন্ত্রের প্রচলনও তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। পিথাগোরাস (খ্রিস্টপূর্ব ৫৭০–৫০০ অব্দ) বৈজ্ঞানিকভাবে গান গাওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। নগররাষ্ট্রগুলোতে তারা সুন্দর সুন্দর মন্দির নির্মাণ করতো। প্রথমদিকে তারা কাঠ, পরে রৌদ্রে শুকানো ইঁট এবং অবশেষে পাথর দিয়ে মন্দির নির্মাণ করতো। রাজপ্রাসাদ, প্যাভিলিয়নস্, বসবাসের জন্য গৃহ, লাইব্রেরী, মিউজিয়াম, ব্যায়ামাগার, আলোগ্রহ, থিয়েটার গৃহ ইত্যাদি গ্রিক স্থপতিগণ সুন্দরভাবে তৈরি করতো। পারগামাম, প্রাইয়িন, আলেকজান্দ্রিয়া প্রভৃতি শহরগুলো হেলেনেস্টিক যুগে সুন্দর সুন্দর ইমারত দ্বারা সুশোভিত করা হয়েছিল। ইমারত নির্মাণে করিনথিয়ান কলাম (স্তম্ভ), মেঝেতে মোজাইক এবং দেয়ালে ছবি অঙ্কনের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।


গ্রিক সভ্যতার চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্য
প্রাথমিক যুগে গ্রিক চিত্রশিল্পীরা পাত্রে জীবজন্তু এবং বিভিন্ন প্রকার চিত্তাকর্ষক বিষয় অঙ্কন করতো। চিত্রকর ডুরিস আজান্স ও অডেসাসের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষ সুন্দরভাবে চিত্রিত করে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। এ যুগে কাঠ ও দেয়াল চিত্রিত করা হতো। মহান আলেকজান্ডারের দরবার চিত্রকর ( এ্যাপেলেস) একটি চিত্রাঙ্কনের স্কুল স্থাপন করেছিলেন। মানুষ, শকট, ঘোড়া ইত্যাদি জীবজন্তুর ভাস্কর্য সে যুগের ভাষ্করগণ অত্যন্ত নিপুণভাবে পাথরে খোদাই করে নির্মাণ করতো।


গ্রিক সভ্যতার ধর্ম ও দর্শন
গ্রিকদের নিকট দেবতারা ছিলেন মহিমান্বিত ব্যক্তিত্ব, পার্থিব ও লোভী। তবে দেবতারা অমর। জিয়াস গ্রিকদের সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। তিনি তার স্ত্রী ও পুত্র - কন্যাসহ মোট ১২ জন সদস্যসহ ওলিমপাস পাহাড়ে বসবাস করেন। ডিমিটার, হেডেস, এথেনা, এ্যাপোলো প্রভৃতি দেবতাগণ গ্রিকদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। অলিম্পিক খেলাধূলাও ছিল তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত। বিশ্ববিখ্যাত সক্রেটিস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০–৩৯৯ অব্দ), প্লেটো ( খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭–৩৪৭ অব্দ), এ্যারিস্টটল ( খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪–৩২২ অব্দ), ইপিকিউরাস (খ্রিস্টপূর্ব ৩৪২–২৭০ অব্দ), জেনো (খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০–২৬০ অব্দ) প্রমুখ ছিলেন গ্রিক দার্শনিক। তাঁরা মানবজাতি বিশ্ব মানুষের আত্মা দেবতার একতৃতা, মানুষের অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও তত্ত্ব প্রদান করেছেন। বিজ্ঞান, দর্শন ও নীতিশাস্ত্রের অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাঁদের অসামান্য অবদান রয়েছে।


গ্রিক সভ্যতার সাহিত্য
কিছুসংখ্যক অক্ষর সংযোগ করে এবং কিছুসংখ্যক অক্ষর বাদ দিয়ে গ্রিকগণ ফিনিসীয়দের অফারসমূহ গ্রহণ করেছিলেন। প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক হোমার সে যুগে ইলিয়াড ও ওডিসি' নামক মহাকাব্য রচনা করে অমর হয়ে রয়েছেন। গ্রিক সাহিত্যিকগণ গীতিকাবা, নাটক ইত্যাদিও রচনা করেন। সে যুগের ঐতিহাসিক হেরোডোটাস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪ অব্দ) অদ্যাবধি “ইতিহাসের জনক" হিসেবে পরিচিত। ঝুঁকিডিস্ ছিলেন সে যুগের আর একজন শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক । বাগ্যিতাও প্রাচীন গ্রিসে সাহিত্যের অমূল্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো।

গ্রিক সভ্যতার বিজ্ঞান
গ্রিসে জ্ঞান - বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে দার্শনিকের অবদান রয়েছে অপরিসীম। জেনোর স্কুল এবং ইপিকিউরাসের স্কুল ছিল জ্ঞান - বিজ্ঞান চর্চার প্রধান দুটি কেন্দ্র। পেরিকোলেসের যুগে উঁচু শ্রেণির জনগণ প্রায় সবাই লিখতে ও পড়তে জানত এবং স্বল্পসংখ্যক লোক গবেষণা কাজেও নিযুক্ত থাকতো। হেলেনিস্টিক যুগে আলেকজান্দ্রিয়া, পারগামান, এথেন্স, এন্টিঅক এবং টারসাসে লক্ষ লক্ষ মূল্যবান গ্রন্থের লাইব্রেরী স্থাপিত হয়েছিল। গ্রিক বিজ্ঞানিগণ (থিওফ্রাসটাস, ডাইওস কোৱাইডস্, এ্যারিসটারকাস প্রমুখ) উদ্ভিদবিদ্যা, গ্রহ-নক্ষত্র, পৃথিবীর পরিধি, মানচিত্র, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমা ইত্যাদি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। জ্যামিতি সম্পর্কে তাদের যাচ্ছ ধারণা ছিল। পিথাগোরাস (খ্রিস্টপূর্ব ৫৭০–৫০০ অব্দ), ইউক্লিড, আর্কিমিডিস, হিস্পারকাস প্রমুখ ছিলেন বিখ্যাত অঙ্কনশাস্ত্রবিদ। প্রাণিবিদ্যা ও চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কেও গ্রিক বিজ্ঞানিগণ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। হিপ্রোকেটস ও হিরোফিলাস ছিলেন বিখ্যাত চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ।

গ্রিক সভ্যতার মূল্যায়ন ও প্রভাব
গ্রিসের এথেন্সে পেরিকেলস যুগের ন্যায় বিশ্বের কোথাও প্রাচীনকালে একটি দেশে একই সময় এত বেশি পণ্ডিত ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেনি। ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, জ্ঞান - বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় সে যুগের গ্রিক পণ্ডিতগণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সক্রেটিস, প্লেটো ও এ্যারিস্টোটল সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ছিলেন। ভাস্কর্য, শিল্পকলা, স্বাগতা শিল্প, ধর্ম, সাহিত্য, ইতিহাস, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদের অবদান সকল দেশের ও সকল যুগের জনগণের নিকট অম্লান হয়ে থাকবে। গ্রিক পণ্ডিতদের পাণ্ডিত্যের প্রভাব প্রাচ্য, পাশ্চাত্য মুসলিম ও অমুসলিম বিশ্বের সকল দেশ ও জাতির উপর বিদ্যমান থাকবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url