দ্বি - জাতি তত্ত্ব || Two Nation Theory

 দ্বি - জাতি তত্ত্ব কি? 

 ভারতের মুসলমানদের ধর্মভিত্তিক পৃথক আত্মপরিচয়ের চেতনায় উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ করার জন্য মুসলিমলীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার আলোচিত দ্বি-জাতি তত্ত্ব উত্থাপন করেন। এ তত্ত্বের মূল বক্তব্য হচ্ছে, ভারতের হিন্দু ও মুসলমানরা কেবল ভারতীয় নয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্নাতন্ত্র্যের ভিত্তিতে দুটি আলাদা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিদার। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের বরাবরের প্রাধান্য , মুসলিম সম্প্রদায়ের অনগ্রসরতা ও তাদের প্রতি উপেক্ষা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈরিতা জিন্নাহর এ তত্ত্বের বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করা হয়। ১৯৩৭ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অধিবেশনে জিন্নাহ প্রথম ভারতীয় মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে উল্লেখ করেন। ১৯৩৯ সালে জিল্লাহ দ্বি - জাতি তত্ত্বের ধারণা দেন এবং এ তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতের মুসলমানদেরকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে ঘোষণা করেন । ১৯৪০ সালের ২২-২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি তাঁর দ্বি - জাতি তত্ত্বের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন । তিনি বলেন , মুসলমানরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নয়, বরং তারা যেকোনো সংজ্ঞা অনুসারে একটি জাতি। সুতরাং তাদের অবশ্যই একটি পৃথক আবাসভূমি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড এবং রাষ্ট্র থাকতে হবে (Musalmans are not minority, Musalmans are a nation according to any definition of a nation ..... So they are in need of a separate homeland , a territory and a state.)। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঐতিহাসিক ঘোষণাই ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে 'দ্বি - জাতি তত্ত্ব' নামে খ্যাত। 

দ্বি - জাতি তত্ত্বের তাৎপর্য 

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি - জাতি তত্ত্বের ধারণা তৎকালীন ভারতবর্ষের মুসলিম সমাজকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছিল। দ্বি - জাতি তত্ত্ব ভারতীয় মুসলিম সমাজকে এক নবচেতনায় উজ্জীবিত করে। তৎকালীন মুসলিম সমাজের প্রেক্ষাপটে এ তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরা হলো: 

১. জিন্নাহর দ্বি - জাতি তত্ত্ব ভারতীয় মুসলমানদের নিজস্ব স্বতন্ত্র ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত করে। ধর্ম যে জাতি গঠনের একটি শক্তিশালী উপাদান দ্বি - জাতি তত্ত্বের মাধ্যমে তা তিনি ভারতীয় মুসলমানদের উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

২. দ্বি - জাতি তত্ত্বের ধারণা ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে দৃঢ় সাম্প্রদায়িক ঐকাবোধ জাগ্রত করে। দ্বি - জাতি তত্ত্ব ঘোষণার পর মুসলমানরা নতুন করে উপলব্ধি করে, আর্থ - সামাজিক মুক্তির জন্য তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

৩. দ্বি - জাতি তত্ত্ব ভারতীয় মুসলিম সমাজকে রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত করে। এতে করে তারা নিজেদের স্বতন্ত্র ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চিন্তাধারার চর্চা নিশ্চিত করার জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন হয়।

৪. তৎকালীন ভারতের মুসলিম সমাজে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ সাধনে দ্বি - জাতি তন্তু সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ তত্ত্ব ভারতের মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য , সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে। 

৫. জিন্নাহর দ্বি - জাতি তত্ত্ব তৎকালীন ভারতে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক আবহ সৃষ্টি করে মূলত তার ওপর ভিত্তি করেই ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। 

পরিশেষে বলা যায়, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষপর্বে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি - জাতি তত্ত্ব এ অঞ্চলের মুসলমানদের নতুন চেতনায় উজ্জীবিত করে তাদের জন্য পৃথক আবাসভূমির দাবিকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪০ সালে উত্থাপিত লাজ্যের প্রস্তাব ছিল এ দ্বি - জাতি তত্ত্বেরই ধারাবাহিকতা। লাহোর প্রস্তাব দ্বি - জাতি তত্ত্বের ধারণাকে আরও স্পষ্ট ও বাস্তব করে তোলে। দ্বি - জাতি তত্ত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই তৎকালীন ভারতের মুসলমানরা ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার জন্য ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এর চূড়ান্ত পরিণতিতে ১৯৪৭ সালে জন্ম নেয় স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url