বঙ্গভঙ্গের কারণ ও ফলাফল || Causes and Consequences of partition of Bengal

 বঙ্গভঙ্গ কি? 

 ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংস্কার ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে বঙ্গভঙ্গকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মূলত প্রশাসনিক কার্যক্রমের সুবিধার্থে ভারতের তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড কার্জন ( George Nathaniel Curzon ) প্রায় ২ লক্ষ বর্গমাইল আয়তনের বিশাল ‘ বাংলা প্রেসিডেন্সি’কে বিভক্ত করেন । তিনি পূর্ব বাংলাকে আসামের সাথে যুক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করেন। ঢাকা হয় এ প্রদেশের রাজধানী । অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গ , বিহার ও উড়িষ্যাকে একত্রিত করে বাংলা প্রদেশ গঠন করেন। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বাংলা প্রেসিডেন্সিকে এভাবে দুটি প্রদেশে বিভক্ত করার বিষয়টিই ভারতের ইতিহাসে ‘ বঙ্গভঙ্গ ' নামে পরিচিত।


বঙ্গভঙ্গের প্রভাব 

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের ফলে বাংলার হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরবিরোধী প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় । এর ফলাফল পরবর্তীকালের রাজনৈতিক ঘটনাবলির ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রেখেছিল। যথা-

 মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া: পূর্ববঙ্গের মুসলমানগণ বঙ্গভঙ্গের ফলে নিজেদের উন্নয়নের আশায় বুক বাধে । নবাৰ স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে তারা এ পরিকল্পনাকে স্বাগত জানায় । পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষ করতে নতুন প্রদেশকে টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে নবাব সলিমুল্লাহ আপসহীন সংগ্রাম করেন । পূর্ব বাংলার উদ্দীয়মান নেতা এ . কে . ফজলুল হক এবং জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরীসহ অনেকে তাকে সমর্থন করেন । তবে বহুসংখ্যক মুসলিম বুদ্ধিজীবী বাঙালি জাতির মধ্যে বিভেদের ষড়যন্ত্র আখ্যায়িত করে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন।

হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া: বগভঙ্গের প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের অবস্থান ছিল নেতিবাচক । নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসাম গঠিত হওয়ায় অনেক নিম্নবর্ণের হিন্দু বঙ্গভঙ্গের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত , উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বজাভাকে মেনে নিতে পারেনি । স্বার্থহানি হওয়ার আশঙ্কায় তারা বক্তাভঙ্গের চরম বিরোধিতা করে । অনেকে মাতৃভূমির অঙ্গচ্ছেদ বিবেচনা করেও এর বিরোধিতা করে।

 বঙ্গভঙ্গে কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া : জাতীয় কংগ্রেস দল বঙ্গভঙ্গের প্রশ্নে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরোধিতার নীতিকে সমর্থন করে । এতে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয় । বস্তুত প্রভাবশালী দল কংগ্রেসের সমর্থনের কারণেই শিক্ষিত , উচ্চবিত হিন্দু সম্প্রদায় বক্তশভাগের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিল। 

বঙ্গভঙ্গ রদের কারণ 

পূর্ববাজার জনগণের জন্য বস্তাভজা ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা । বাংলা প্রদেশ বিভক্ত করার ফলে ঢাকা পর্ববঙ্গের প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয় । বঙ্গবঙ্গোর পর প্রই ঢাকায় নতুন নতুন সুরম্য অট্টালিকা , হাইকোর্ট , সেক্রেটারিয়েট , আইন পরিষদ ভবন , কার্জন হল ইত্যাদি নির্মিত হয় । লর্ড কার্জন স্বয়ং ঢাকায় এসে ঢোকাকে নতুন শাসনবিভাগীয় এককো কেন্দ্রবিন্দু ঘোষণা করেন কার্জন স্যার জোসেফ ব্যামফিল্ড ফুলারকে ( Sir Joseph Bampiylde Euller ) পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিযুক্ত করেন । পূর্ববঙ্গের জনগণ নতুন উদ্দীপনা নিয়ে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে ব্রতী হয়। 

কিন্তু অচিরেই বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা শুরু হয় । বাংলার জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ বাগভঙ্গকে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নস্যাতের ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেন । তারা একে অন্যায় ও অযৌক্তিক বলে বর্ণনা করেন । রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকে বলেন , বক্তাভঙ্গের অর্থ হচ্ছে মাতৃভূমি বাংলাকে বিভক্ত করা । এর ফলে মাতৃভূমি কলঙ্কিত হয়েছে। স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি , শ্রী অরবিন্দ ঘোষ , শ্রী বিপিন চন্দ্র পাল , দাদাভাই নওরোজী প্রমুখ বিশিষ্ট নেতা বস্তাভঙ্গের পরিকল্পনাকে অযৌক্তিক ও অপমানজনক আখ্যায়িত করেন। ধীরে ধীরে এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে । আন্দোলনকারীরা বাগভঙ্গের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে দুই ধরনের পদক্ষেপ নেয়। যথা— ক . ব্রিটিশ পণ্য বর্জন তথা দেশি আন্দোলন এবং খ . ইংরেজ সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের জায়ভীতি প্রদর্শন ও হামলা।

 ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের মাধ্যমে ব্রিটিশ মিল মালিক তথা সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়। সারা ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের জয়গান শুরু হয় এবং জনগণ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে । পত্র - পত্রিকায় চরম উত্তেজনাকর খবর ও সম্পাদকীয় লিখিত হতে থাকে । ধীরে ধীরে বাতাবিরোধী আন্দোলন ' ব্রিটিশ খেদাও ' আন্দোলনে রূপ নিতে থাকে । অবস্থাদৃষ্টে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।

কলকাতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীরা বজাভঙ্গের পরিকল্পনাকে ব্রিটিশ সরকারের ভারতবাসীকে বিতর্ক করে শাসন করার কূটকৌশল বলে উল্লেখ করেন। প্রচন্ড আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় । ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে দিল্লির দরবারে সম্রাট পঞ্চম জর্জের ( George Frederick Emest Alben ) রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষনা করা হয়।

বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়া 

ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা করায় পশ্চিম বাংলার রাজনীতিক , বুদ্ধিজীবীসহ অবস্থাপন্ন হিন্দু সম্প্রদায় উল্লসিত হয়ে ওঠে । কেননা বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ আবার একত্রিত হওয়ায় কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত ও বিত্তশালীরা তাদের হারানো প্রভাব - প্রতিপত্তি ফিরে পান।

 ব্যবসায়ীরা উল্লসিত হয় এ কারণে যে , কলকাতা আবার সমগ্র বাংলার ব্যবসা - বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হবে । আইনজীবীরা ভাবলেন , তাদের পূর্ব বাংলার মক্কেলরা আবার কলকাতায় ছুটে আসবে । এক কথায় বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় কলকাতাকেন্দ্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু নেতা , জমিদার , ব্যবসায়ীমহল ও পেশাজীবীরা তাদের হারানো গৌরব ও প্রভাব - প্রতিপত্তি ফিরে পান। 

অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার ঘোষণা শুনে পূর্ববঙ্গের মুসলিমরা , বিশেষ করে অভিজাত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় হতাশ হয়ে পড়ে । ‘ পূর্ববঙ্গ ও আসাম ' নামের নতুন প্রদেশ গঠিত হওয়ায় তাদের মধ্যে যে উৎসাহ , প্রাণচাঞ্চল্য ও জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল , বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা তা স্তব্ধ করে দেয় । এর ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মনে চরম হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

 নবাব স্যার সলিমুল্লাহসহ অনেক মুসলিম নেতাই ব্রিটিশ সরকারের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেন । অপরদিকে , বঙ্গভঙ্গের পক্ষে - বিপক্ষে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দীর্ঘদিনের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও বিনষ্ট হয়।

বঙ্গভঙ্গের কারণ

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পেছনে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কারণ ছিল । যথা-

প্রশাসনিক কারণ : বঙ্গভঙ্গের পেছনে প্রশাসনিক কারণ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । বাংলা প্রেসিডেন্সির জনসংখ্যা তখনই ছিল প্রায় ৭ কোটি ৮০ লক্ষ । এ অতি জনবহুল বিশাল ভূখণ্ডকে কেন্দ্র থেকে একজন গভর্নরের পক্ষে শাসন করা ছিল দুরূহ ব্যাপার । বিশেষ করে নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গের যোগাযোগ , পুলিশ ও ডাকব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত অনুন্নত। এমন প্রেক্ষাপটে ১৮৫৩ সালে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ স্যার চার্লস গ্রান্ট ( Charles Grant ) সর্বপ্রথম বাংলা প্রদেশকে দুভাগে বিভক্ত করার সুপারিশ করেন । ব্রিটিশ সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তা রিজলী ১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রশাসনিক সুবিধার্থে বাংলার ভৌগোলিক সীমারেখা পুনর্বিন্যাসের সুপারিশ করেন।


রাজনৈতিক কারণ : বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক কারণের দুটি দিক ছিল— 

ক . ভাগ কর ও শাসন কর নীতি : ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ভূখণ্ডে ইংরেজ শাসকদের অনুসৃত কথ্যাত একটি প্রশাসনিক নীতি ছিল Divide and Rule ' ( ' ভাগ কর ও শাসন কর ' নীতি ) । ক্রমবর্ধমান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করে ভারতীয়দের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে হবে । এক্ষেত্রে তারা ভারতের প্রধান দুটি ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে । এ নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে তারা হিন্দু - মুসলিম বিভাজন ঘটানোর পরিকল্পনা করে।


খ . জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নস্যাৎ করা : উনিশ শতকের শেষ দিকে ভারতীয়রা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টায় ১৮৮৫ সালে গড়ে তোলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। বাংলা প্রদেশ , বিশেষ করে কলকাতা ছিল কংগ্রেসের রাজনীতির অন্যতম শক্তিশালী কেন্দ্র। ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে নস্যাৎ করা এবং বিপ্লবীদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বঙ্গভঙ্গ নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে।

 অর্থনৈতিক কারণ: বঙ্গভঙ্গের অর্থনৈতিক কারণের মধ্যে রয়েছে— 

 ক . পূর্ববাংলার কৃষিজীবী জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ শোষণ করে জমিদারশ্রেণি বাংলার রাজধানী কলকাতায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করত । এসব জমিদারের বেশিরভাগই ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী । অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ ছিল কৃষিজীবী মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইংরেজ সরকার বা জমিদারশ্রেণি কেউই পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়নি এরূপ পরিস্থিতিতে পূর্ববঙ্গের অবহেলিত মুসলমানরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বঙ্গভঙ্গের দাবি জানায়।

খ. তৎকালীন ভারতের বৃহত্তম নগর কলকাতা বাংলা প্রেসিডেন্সির কেন্দ্র হওয়ায় সেখানেই প্রায় সব অফিস - আদালত , উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান , কলকারখানা ইত্যাদি স্থাপিত হয় । কোলকাতা ছিল গোটা দেশেরই রাজধানী । এ কারণে শিল্প , বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে পূর্ববঙ্গ থেকে যারা অনুন্নত । পূর্ব বাংলায় প্রতি এই অবহেলার অবসান ঘটিয়ে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বঙ্গভঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

সামাজিক কারণ : পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ মানুষ ছিল মুসলমান যাদের মূল পেশা ছিল কৃষি। আর এ অঞ্চলের অধিকাংশ জমিদার ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাদের অত্যাচার ও শোষণে মুসলমান সম্প্রদায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল । বস্তুত ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই বিভিন্ন কারণে ব্রিটিশ সরকার হিন্দুদের প্রতি উদার এবং মুসলমানদের ওপর বৈরী নীতি অনুসরণ করতে থাকে। ইংরেজিসহ আধুনিক শিক্ষাগ্রহণে মুসলমানদের অনীহা ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে তাদের দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়। এমন অবস্থায় হিন্দু জমিদারদের শোষণ - নির্যাতন মুসলমানদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি করে । আর সে কারণেই লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা দিলে মুসলমানরা একে স্বাগত জানায়।

বঙ্গভঙ্গের ফলাফল 

 ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক অগ্রগতির ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ একটি অন্যন্য সাধারণ ঘটনা। বঙ্গভঙ্গের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

১. ব্রিটিশদের ভাগ কর ও শাসন করা নীতির বিজয়: বঙ্গভঙ্গের ফলে ব্রিটিশ শাসকদের অনুসত ভাগ কর ও শাসন কর নীতি ' ( Divide & Rul Policy ) জয়যুক্ত হয়। ব্রিটিশ শাসকগণ কৌশলে হিন্দু ও মুসলমান জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয় । এর ফলে ভারতের বৃহত্তম দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায় চিন্তা - চেতনার দিক থেকে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

২. ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নস্যাৎত্তরণ: বঙ্গভঙ্গের দ্বারা ব্রিটিশ শাসকগণ কৌশলে কলকাতাকেন্দ্রিক সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নস্যাৎ করার সুযোগ লাভ করে । কারণ কলকাতা শহরের লেখক , সাহিত্যিক , বুদ্ধিজীবী , অর্থনীতিবিদ , রাজনীতিবিদগণ পূর্ববাংলার উপর নির্ভরশীল ছিল । বঙ্গভঙ্গের ফলে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৩. সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি : বঙ্গভঙ্গ হিন্দু - মুসলিম জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিষবৃক্ষ রোপণ করে । সাম্প্রদায়িক চেতনাই পরবর্তীকালে ভারত বিভাগকে তরান্বিত করে।

৪. মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রসার: বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলিম জাতীয়তাবাদের বীজ রোপিত হয়। মুসলমান জনগণ নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব ও স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগঠিত হতে থাকে। তারা ১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নামে একটি পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে।

৫. মুসলিম লীগের জন্ম: নতুন প্রদেশের অস্তিত্ব রক্ষা এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক আশা - আকাঙ্ক্ষা লক্ষ্যে ১৯০৬ সালে ঢাকায় 'মুসলিম লীগ ' নামক রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়।

৬ . হিন্দু - মুসলমান সম্পর্কের অবনতি: বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ খুশি হলেও হিন্দু সম্প্রদায় খুশি হয়নি। এ জন্যই বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য হিন্দু জনগণ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু করে।

৭. স্বদেশি আন্দোলন: বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য হিন্দু জনগণ এবং কংগ্রেস স্বদেশি আন্দোলন গড়ে তোলে আন্দোলনকারীরা বিলেতি দ্রব্য বর্জন , শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস - আদালত বর্জনের ডাক দেয়।

৮. সন্ত্রাসবাদ ও উগ্র হিন্দুবাদীদের উত্থান: একদল উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য গোপন প্রচেষ্টা চালায়। এর ফলে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে বাংলা, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায় এবং রাজনীতিতে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। 

৯. পূর্ব বাংলার উন্নতি : বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ একে স্বাগত জানায়।  পূর্ব বাংলার উন্নতি ও অগ্রগতির পথ প্রশস্ত হয় । শিক্ষা , সংস্কৃতি , অর্থনীতি , যোগাযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url