বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি || Foreign Policy of Bangladesh

 বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি 

পররাষ্ট্রনীতি যেকোনো রাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক নির্ধারণের অন্যতম কৌশল । ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন 'প্রবাসী' বা মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সূচনা হয়। এই সময় পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত তৈরি এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের সমর্থন আদায় করা। স্বাধীনতা অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পূনর্গঠনের জন্য দরকার ছিল আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সাহায্য । এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ( ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঘোষণা করলেন "Friendship to all , malice to none' অর্থাৎ সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়। এই উক্তির মধ্যেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল তাৎপর্য নিহিত। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল প্রতিপাদ্য ( Theme ) এটাই। এদেশের ভিশন ও মিশন নির্ধারণ করতে গিয়ে শেখ মুজিব বলেছিলেন, 'বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড'। পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে তিনি যে নির্দেশনা প্রদান করেন তা হলো- 

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি

১. ইতিবাচক নিরপেক্ষতা ( Positive Neutrality ) , 

২. শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান Peaceful Coexistence ) 

৩. জোট নিরপেক্ষতা ( Non Alignment ) , 

৪. সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ( Friendly Relations to all)।

স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার কর্তৃক গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি গঠনে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে। এ দশকেই বিশ্বের বেশিরভাগ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। বাংলাদেশ জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা , যেমন- কমনওয়েলথ , ইসলামি সম্মেলন সংস্থা ( ওআইসি ) ও জোটনিরপেক্ষ সংস্থার ( আন্দোলন ) সদস্যপদ লাভ করে । এছাড়া বাংলাদেশ আট দেশীয় জোট দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার ( সার্ক) সাদস্য। সার্ক প্রকৃত লক্ষ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লে বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ বিমসটেক ( BIMSTEC ) কে শক্তিশালী করার কূটনৈতিক উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে দুই মেয়াদে অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫ ( ১ ) অনুচ্ছেদ পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে , " জাতীয় সার্বভৌম ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা , অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা , আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা" - এ সকল নীতিই হবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি। এ সকল নীতির ভিত্তিতেই রাষ্ট্র- 

ক. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ সম্পূর্ণ নিরস্ত্রকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন, 

খ. প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পদ্মার মাধ্যমে নিজস্ব সামাজিক , অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন ' 

গ. সাম্রাজ্যবাদ , ঔপনিবেশিকতাবাদ যা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।

 বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম সায়লা অরোন্নত রাষ্ট্রসমূহের নেতৃত্ব দান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে জাপান , ব্রিটেন এবং আরো কিছু উন্নত দেশের সাথে "বাংলাদেশ এইড কনসোর্টিয়াম" গঠন করে যান যুগ্ম সভাপতির নেতৃত্বে ছিল বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য 

সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য । বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হলেও দেশটি নিজ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে বর্তমানে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশটি আরও উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য Economic Diplomacy বা অর্থনৈতিক কূটনীতি। তাই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য ধনী দেশগুলোর সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য।

 স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাধীনতা , সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা এবং সমতা বজায় রাখা । তাছাড়া বাংলাদেশ শান্তিকামী দেশ হিসেবে সব দেশের সাথেই বন্ধুত্ব কামনা করে একইসাথে কারও প্রভুত্ব স্বীকার করে না। যারা অন্যের স্বাধীনতাকে খর্ব করে এমন দেশকে বাংলাদেশ সমর্থন করে না। বাংলাদেশ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। যেকোনো রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সাভারের প্রতি তাই বাংলাদেশের জোরালো সমর্থন রয়েছে। সাধারণত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহ তার পররাষ্ট্রনীতিতে সঙ্ক সময়ে ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করে। ইরাকের কুয়েড আগ্রাসন , ইসরাইলের ফিলিস্তিন ভূ - খণ্ড দখল প্রভৃতি কাজ বাংলাদেশ সমর্থন করেনি।

জাতীয় পরিচয় তুলে ধরা: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য জাতীয় পরিচয়কে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা। কেননা , বাংলাদেশ এক সময় ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে ছিল। তাই সব ধরনের বর্ণবাদ , উগ্রবাদ , ঔপনিবেশবাদ , সন্ত্রাসবাদ দূরীকরণ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য। আর সব ধরনের বর্ণবাদ , উপনিবেশবাদ ও সন্ত্রাসবাদের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় পরিচয়কে তুলে ধরাই হচ্ছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য এবং এটাকে সামনে রেখেই বাংলাদেশ অন্য রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে বন্ধপরিকর।

 আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা: আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান শান্তির পক্ষে এবং যেকোনো ধরনের যুদ্ধ ও অনার বিপক্ষে জালিক ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ প্রত্যাশা করে। এই কারণেই বাংলাদেশ সব সময় অস্ত্র প্রতিযোগিতা, সংঘর্ষ ও জাতিগত দাঙ্গার বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও নিরস্ত্রীকরণের কথা বলে। তাই উপমহাদেশে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে।

আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপন ; ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মরিস ইস্ট বলেছিলেন- " ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক সংগঠনের কার্যাবলিতে বেশি অংশগ্রহণ করতে চায়।"

 বাংলাদেশ যেহেতু একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মরিস ইস্টের এই কথাটি পুরোপুরি সত্য। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করা এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্য হিসেবে নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (New Economic Order) কে সমর্থন দান এবং ধনী-দরিদ্র দেশের  মধ্যকার আলোচনাকে এগিয়ে নেওয়া। আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপনের ফলে একদিকে যেমন বাণিজ্যিক দিক থেকে বাংলাদেশ বানান হত পরে অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে সুনাম অর্জন করতে পারে। যে সুনামের  ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি  সফলতার মুখ দেখতে পারে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url