রাষ্ট্র কি? || What is the state?

রাষ্ট্র

রাষ্ট্র হচ্ছে সামাজিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সমাজে বসবাসরত সকল মানুষকে একটি ঐক্য সূত্রে বাঁধা এবং তাদের কল্যাণ ও সমস্যা সমাধানের জন্যই রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে। সমাজ বিকাশের একটি স্তরে সমাজের মধ্য থেকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটেছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাষ্ট্রকে মনে করা হতো ঈশ্বরের সৃষ্টি করা একটি প্রতিষ্ঠান। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রকে ‘ সর্বজনীন কল্যাণ সাধনকারী এবং “মানুষের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য ’ প্রতিষ্ঠান বলে ব্যাখ্যা করেছেন। রাষ্ট্র হলো নাগরিকদের জন্য। নাগরিকের সুখ ও শান্তি বিধান করার জন্য রাষ্ট্রকে অনেক কাজ করতে হয়। রাষ্ট্রের এই কাজ কতগুলো অপরিহার্য এবং কতগুলো ঐচ্ছিক। আবার রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদেরও বেশ কিছু দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করতে হয় । অন্যদিকে নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা বিধান এবং সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলো প্রতিরোধ ও প্রতিকারে আইনের বিধিবিধান আবশ্যক।

রাষ্ট্রের ধারণা

প্রত্যেক মানুষ কোনো না কোনো রাষ্ট্রে বসবাস করে। হঠাৎ করে কোনো রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়নি। আদিম মানুষ প্রথমে গোত্রভিত্তিক বসবাস করত। সময়ের পরিবর্তনে একসময় রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। মানুষই রাষ্ট্র সৃষ্টি করে । রাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রত্যেক নাগরিকেরই রাষ্ট্রের নিয়ম - কানুন মেনে চলতে হয়। রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগণকে ঐ রাষ্ট্রের নাগরিক বলা হয় । নাগরিকদের সুন্দর সুষ্ঠুভাবে বাঁচার জন্য রাষ্ট্র অনেক কাজ করে থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক তত্ত্ববিদরা রাষ্ট্রকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে, স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনের জন্য কতিপয় পরিবার ও গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত সংগঠনই রাষ্ট্র।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর . এম . ম্যাকাইভারের মতে , "রাষ্ট্র হচ্ছে সরকার কর্তৃক প্রণীত আইন দ্বারা পরিচালিত একটি সংগঠন , যার কর্তৃত্বমূলক ক্ষমতা রয়েছে এবং যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসরত অধিবাসীদের ওপর বলবৎ হয়।"

অধ্যাপক গার্নার রাষ্ট্রের সবচেয়ে সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেন , "রাষ্ট্র হলো বহুসংখ্যক ব্যক্তি নিয়ে গঠিত এমন এক জনসমাজ , যারা নির্দিষ্ট ভূখন্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে , যা বহির্ভূক্তির নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত এবং যাদের একটি সুসংগঠিত সরকার আছে , যে সরকারের প্রতি ঐ জনসমাজ স্বভাবতই অনুগত।" 

সুতরাং , আমরা বলতে পারি , রাষ্ট্র হলো একটি ভূখণ্ডভিত্তিক সমাজ বিশেষ , যার সংগঠিত সরকার ও জনসমষ্টি রয়েছে এবং যার নিজস্ব ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত আছে।
রাষ্ট্র কি?

রাষ্ট্রের উপাদান 

রাষ্ট্রের ধারণা ব্যাখ্যা করলে আমরা রাষ্ট্রের চারটি উপাদান দেখতে পাই, যথা- জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড , সরকার তা সার্বভৌমত্ব। প্রত্যেক রাষ্ট্রই এ চারটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত।

জনসমষ্টি : রাষ্ট্রের প্রাথমিক উপাদান হচ্ছে জনসমষ্টি । জনসমষ্টি বলতে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনগণকে বোঝায়। রাষ্ট্র গঠনের জন্য জনসমষ্টি একান্ত অপরিহার্য। জনসমষ্টির ঐকাবন্ধ হওয়ার ইচ্ছা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক হতে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। তবে রাষ্ট্র গঠনের জন্য জনসংখ্যা কত হবে তার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রের জনসংখ্যা কয়েক কোটি হতে পারে। আবার কয়েক হাজারও হতে পারে। গণচীন ও ভারতে জনসংখ্যা একশ ' কোটির উপরে। অন্যদিকে স্যানম্যারিনো ও মোনাকো এ দুটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জনসংখ্যা যথাক্রমে ৩৮,৩০০ ও ৩৮,১৬৩ (২০১৯ সালে বিশ্ব জনসংখ্যার প্রতিবেদন অনুযায়ী)। 

নির্দিষ্ট ভূখণ্ড: নির্দিষ্ট ভূখণ্ড হচ্ছে রাষ্ট্রের অপরিহার্য দ্বিতীয় উপাদান। প্রত্যেক রাষ্ট্রই একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। ভূখণ্ড বলতে স্থলভাগ , সমুদ্রসীমা, আকাশসীমাও বোঝায়। রাষ্ট্রের জনগণের বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। জনসমষ্টি ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সংগ্রাম ও যুদ্ধের মাধ্যমে অথবা সাংবিধানিকভাবে নির্দিষ্ট ভূখন্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিটি রাষ্ট্রই ভূখন্ডের সীমানাকেন্দ্রিক নিরাপত্তা বেষ্টনি গড়ে তোলে। ভূখণ্ড বড় বা ছোট হতে পারে, যেমন - রাশিয়ার আয়তন অনেক বড় আর ছোট আয়তনের রাষ্ট্র হলো- দারুস সালাম , সুইজারল্যান্ড, ব্রুনাই ইত্যাদি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভূখণ্ডটি পৃথিবীর মানচিত্রে সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্থান পায়। অনেক সময় রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বেশ কয়েকটি দ্বীপের সমষ্টিও হতে পারে, যেমন- জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি।

সরকার : রাষ্ট্রের অপরিহার্য তৃতীয় উপাদানটি হলো সরকার। সরকার গঠনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ওপর কর্তৃত প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন আংশিকভাবে সম্পন্ন হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তিনটি বিভাগ থাকে আইন বিভাগ , শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। এ তিন বিভাগের সমন্বয়ে সরকার গঠিত হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণতঃ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের সরকার গঠন করে। সরকার পদ্ধতি বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্ন হতে পারে। সরকার বলতে ব্যাপক অর্থে শাসকগোষ্ঠীর সকলকে বোঝায় , যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের ক্ষমতা সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয়। অধ্যাপক গার্নারের মতে, রাষ্ট্র যদি হয় জীবে তবে সরকার হলো এর মস্তিষ্কস্বরূপ। 

সার্বভৌম: রাষ্ট্র গঠনের মুখ্য উপাদান সার্বভৌমত্ব বা সার্বভৌমিকতা। সার্বভৌম শব্দ দ্বারা চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতাকে বোঝায় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রের গঠন পূর্ণতা পায়। এ ক্ষমতা রাষ্ট্রকে অন্যান্য সংবা থেকে পৃথক করে। সার্বভৌমত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের ঐ বৈশিষ্ট্য যার ফলে নিজের ইচ্ছা ছাড়া অন্য কোনো প্রকার ইচ্ছার বারা রাষ্ট্র আইনসঙ্গতভাবে আবদ্ধ নয়। প্রত্যেক সমাজ ব্যবস্থায় চূড়ান্ত ক্ষমতা কার্যকর করার জন্যে একটি মাত্র কেন্দ্রীয়া কর্তৃপক্ষ থাকবে। আর এ ক্ষমতাই হলো সার্বভৌম ক্ষমতা। সার্বভৌমের আদেশই হলো আইন। সার্বভৌমের আদর্শ বা আইন মানতে সকলেই বাবা। 

সার্বভৌম ক্ষমতার অত্যগ্রীণ ও বাহ্যিক দুইটি দিক রয়েছে। প্রয়োগের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মধ্যকার সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। এই সার্বভৌম ক্ষমতার উর্ধ্বে কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের অর্থ হলো রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহির্ভূক্তির নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকবে। কেবল জনসমষ্টি , নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও সরকার থাকা সত্ত্বেও একটি দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষমতা না থাকলে তা রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হবে না। যতদিন রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব বিদ্যমান থাকে ততদিন সার্বভৌমত্বের স্থায়িত্ব থাকবে। সরকারের পরিবর্তন সার্বভৌমত্বের স্থায়িত্বকে নষ্ট করে না। 

সুতরাং, জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখন্ড, সরকার এবং সার্বভৌমত্ব এ চারটি উপাদান নিয়েই রাষ্ট্র গঠিত হয় । এর যে কোনো একটি উপাদান না হলে রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না।

 রাষ্ট্রের কার্যাবলি 

একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র কী কাজ করে কিংবা রাষ্ট্র কী করতে পারে , আমাদের জানা দরকার। অর্থাৎ জনগণের জন্য রাষ্ট্র কী ধরনের সেবা প্রদান করে এবং এর সামর্থ্য কতটুকু এ পাঠ থেকে আমরা তা জানব মানুষের প্রয়োজনেই রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। মানব জীবনের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের কাজ। বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্র প্রধানত দুই ধরনের ভূমিকা পালন করে থাকে, যথা নিয়ন্ত্রণমূলক এবং কল্যাণমূলক  এ দুই ধরনের ভূমিকার ভিত্তিতে আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলিকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যেমন- অপরিহার্য বা মুখ্য কার্যাবলি এবং কল্যাণমূলক বা ঐচ্ছিক কার্যাবলি। 

অপরিহার্য বা মুখ্য কার্যাবলি: রাষ্ট্রের অস্তিত্ত্ব, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্রে বসবাসরত জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্র যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে , সেগুলোকে অপরিহার্য বা মুখ্য কাজ করা হয়। রাষ্ট্রের অপরিহার্য কাজগুলো নিম্নরূপ:

আর . এম . ম্যাকাইভার তাঁর "The Modern State"-এ বলেছেন, ''আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা রাষ্ট্রের প্রাথমিক কাজ বা দায়িত্ব। নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার নিশ্চয়তা থেকে রাষ্ট্র নামক সংগঠনের সৃষ্টি হয়। জনসাধারণকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করা, সমাজের শাম্ভি ভঙ্গকারীদের শাস্তির বিধান করা এবং সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ শান্তি - শৃঙ্খলা বজায় রাখা রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র স্থানীয় , আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে থাকে। রাষ্ট্র আইন - শৃঙ্খলা রক্ষার্থে পুলিশ ও অন্যান্য আধা - সামরিক বাহিনী গড়েছ তোলে। বাংলাদেশে পুলিশ , র‍্যাব, আনসার, গ্রাম প্রতিরক্ষা দা ইত্যাদি আইন - শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। 

জাতীয় নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা রাষ্ট্রের আরেকটি অপরিহার্ব কাজ। দেশের ভৌগোলিক অখস্ততা জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন ও পরিচালনা রাষ্ট্রের এবং বৈদেশিক আক্রমণ থেকে অপরিহার্য দায়িত্ব। আধুনিককালে প্রতিটি স্বাধীন রাষ্ট্রই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলেছে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর সামর্থ্য ও আধুনিকায়ন একটি রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ সুবিধা প্রদান করে। যেমন - আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব প্রদানে তাদের দেশরক্ষা বাহিনীর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

আন্তর্জাতিক অজ্ঞানে রাষ্ট্রকে পরিচিত করা, রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত সম্পদের ওপর দাবি প্রতিষ্ঠিত করা, অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন , বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদন, আঞ্চলিক কোর্ট গঠন, বহির্বিশ্বে অর্থনৈতিক বাজার সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ করা, বিদেশে অবস্থানরত দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সেবা প্রদান করা ইত্যাদি হচ্ছে রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিষয়ক অপরিহার্য কাজ। আইন প্রণয়ন, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের মৌলিক কাজ । রাষ্ট্রীয় আইনসভা বা পার্লামেন্টের মাধ্যমে আইন প্রণীত হয় । দেশের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট , হাইকোর্ট , জজকোর্ট প্রভৃতি বিরোদ্ধে মাধ্যমে দেশের সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা রাষ্ট্রের আবশ্যিক কাজের মধ্যে পড়ে। 

রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদন, নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠে। এ কাঠামোয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ, তাদের কর্মবণ্টন ও নির্দেশ, কাজ তদারক এবং পরিচালনা করা রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। অর্থ ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় অর্থ সংগ্রহ ও বণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলা রাষ্ট্রের একটি মুখ্য কাজ । রাষ্ট্রের বিভিন্ন ধরনের কার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। বিভিন্ন উৎস থেকে এ অর্থ সংগ্রহ করা রাষ্ট্রের আবশ্যিক কাজ। রাষ্ট্রের অধীন বিভিন্ন ব্যক্তি , প্রতিষ্ঠান, মালিকানার ওপর বাজনা ও কর নির্ধ এবং তা আদায় করা ও সুষ্ঠুভাবে ব্যয় করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। 

রাষ্ট্র বাজেট প্রণয়ন, মুদ্রা প্রবর্তন ও মুদ্র বিনিয়োগের ব্যবস্থা , গণনা ও পরিমাপের একক নির্ধারণ এবং মূল্য নির্ধারণ করে থাকে । অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনা মুদ্রাস্ফীতি রোধ , নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রভৃতিও রাষ্ট্রের মুখ্য কার্যাবলি। 

কল্যাণমূলক বা ঐহিক কার্যাবলি: বর্তমানে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের দাবি করে। রাজনৈতিক তত্ত্ববিদরা এখন একমত যে, রাষ্ট্রের ভূমিকা শুধু আইন - শৃঙ্খলা রক্ষা এবং কর আদায়ের মধ্যেই সীমাবন্ধ হওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্রকে অবশ্যই সমাজের সামগ্রিক উন্নতির জন্য, নাগরিকদের নৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক , অর্থনৈতিক জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশে কল্যাণমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। জনকল্যাণ ও উন্নয়নে রাষ্ট্রের এ কাজগুলো ঐচ্ছিক বা গৌণ কাজ। যে রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে বভবেশি উন্নত তার ঐচ্ছিক কার্যাবলি ভভবেশি বিস্তৃত রাষ্ট্রের জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলা রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সম্পদ। 

শিক্ষিত নাগরিক তার অধিকার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন থাকেন এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হন। এজন্য রাষ্ট্র শিক্ষা বিস্তারের প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করে এবং শিক্ষা সুবিধা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। সরকার বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করে নারী শিক্ষার ওপর গুরুত্বসহ ঝালক শিক্ষার বাকরা করে ও নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে। জনসাধারণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং বিদ্যমান বিভিন্ন বৈমা ও কুপ্রথা দূরীকরণে রাষ্ট্রদুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের স্বাস্থ্য রক্ষায় এবং অসুস্থদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে হাসপাতাল, দাতব্য চিকিৎসালয়, শিশুসদন, মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র , দেশব্যাপী অর্থায়ী হেলথ ক্যাম্পেইন প্রতিষ্ঠা প্রভৃতিও পরিচালনা করে। জবাস্থ্য রক্ষায় বিশুদ্ধ পানীর সুব্যবসা, ব্যাংদিষ্কাশন ব্যবস্থা , জোয় প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক টিকা প্রদান প্রভৃতি সেবাও রাষ্ট্র প্রদান করে। এছাড়া যৌতুক ও বাবা গোত্রপ্রথা দূরীকরণ, খাদ্যবিবাহ রোধ এবং জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও পণ্য, যেমন- চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি, তেল ইত্যাদি সরবরাহ প্রক্রিয়া সচল রাখা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজ । তদুপরি খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য উৎপাদন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, কৃষিতে ভর্তুকি প্রদান, সার, বীজ , কীটনাশক সরবরাহ, সেচের ব্যবস্থা করা, বাদ্য গুদামজাতকরণ প্রভৃতি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে স্বীকৃত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খাদ্যের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে । তাই রাষ্ট্রকে বাদ্য নিরাপত্তায় পূর্বের তুলনায় অধিক মনোযোগ দিতে হচ্ছে।

 বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক সাফল্য অর্জন করেছে। যে কোনো রাষ্ট্রের অর্থনেতিক উন্নতি তার শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নয়ন ও প্রসারের সাথে সংশ্লিষ্ট । রাষ্ট্রে নিত্যনতুন শিল গড়ে তোলা, বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠায় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের উৎসাহ ও ঋণ প্রদান, শিল্পজোন প্রতিষ্ঠা , ব্যবসায় - বাণিজ্যের প্রসার , উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি ও রপ্তানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করা রাষ্ট্রের কাজ। আমদানি নির্ভর না হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন যে কোনো রাষ্ট্রের লক্ষ্য হওয়া উচিত। এজন্য বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণার জন্য রাষ্ট্রকে অনেক বেশি নজর দিতে হয়। এছাড়া রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কলকারখানা স্থাপন ও পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ এবং এর মাধ্যমে অধিক সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কাজ। 

দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যথা : রাস্তাঘাট, সেতু, সড়ক, রেলপথ নৌ - চলাচল, বিমান যোগাযোগ ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ এবং যোগাযোগের আধুনিক প্রযুক্তির সাথে সংযুক্ত থাকা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ঐহিক কাজ। বর্তমান বিশ্বে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক বিপ্লব সাধিত হয়েছে । ইন্টারনেট, নেটওয়ার্কিং ও ভরজের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে বিশ্বে পারস্পরিক যোগাযোগ অনেক বেড়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ঐচ্ছিক কাজ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সুষ্ঠু পরিবহন ও যোগাযোগ বাকলা গড়ে তোলা রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য তুলে ধরা রাষ্ট্রের কাজ।

 জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে দেশীয় শিল্প, গান - বাজনা, আঞ্চলিক বৈচিত্র্য রক্ষা, লোকশিল্পের সংরক্ষণ, জাদুঘর প্রতিষ্ঠা, সাংস্কৃতিক আয়োজন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ঐহিক কাজ।

  জনগণের চিত্তবিনোদনের জন্য প্রয়োজনীয় সঞ্চ, খেলার মাঠ , পার্ক ও উদ্যান প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ঐচ্ছিক কাজ হলো জনগণের স্বাধীনতা এবং অধিকার রক্ষা করা। রাষ্ট্র জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চলাচলের স্বাধীনতা , রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এ লক্ষ্যে নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করে। 

এছাড়া জনগণের রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনায় পরিবেশ সৃষ্টি , সংগঠন ও রাজনৈতিক দল গঠনের স্বাধীনতা , জনগণের বিপরীতমুখী স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় সাধন , সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণ, সমাজে দুর্নীতি প্রতিরোধ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার সম্ভক্ষণ, শরণার্থীদের আশ্রয় দান ইত্যাদি রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক রাজনৈতিক কাজ। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। রাষ্ট্রে বসবাসরত দরিদ্র, বিধবা, অনাথ ও প্রতিবন্ধীদের অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সুবিধা প্রদান করা, বেকারদের জন্য ভাড়া, বাবাদের জন্য বয়স্ক ভাতা, পেনশন প্রদান ইত্যাদি সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক কার্যাবলি হিসেবে অন্তর্ভূক্ত। রাষ্ট্রের বিশাল কর্মীবাহিনীকে পরিচালনা করা ও নিয়ন্ত্রণে রাখা রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কাজ। 

শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য শ্রমনীতিমালা প্রণয়ন, ন্যূনতম সঠিক মজুরি ও কাজের সময় নির্ধারণ, কাজের পরিবেশ সৃষ্টি, বোনাস, ইন্স্যুরেন্স, পেনশন সুবিধা প্রদান , কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক তৈরি , কর্মরত বিদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য শ্রম অফিসার নিয়োগ প্রভৃতি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এছাড়া রাষ্ট্র বিবিধ উন্নয়নমূলক ও জনহিতকর কাজ সম্পাদন করে থাকে , যেমন- কৃষি ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বনায়ন কর্মসূচি , প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলা , প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য ও পুনর্বাসন, দুর্ভিক্ষ ও মহামারি প্রতিরোধ , নাগরিক সুবিধা সৃষ্টি , বিদ্যুতায়ন ও জ্বালানি সরবরাহ, প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা , নগরায়ণ, গ্রামীণ উন্নয়ন, কালোবাজারি রোধ , খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ, নারী ও শিশু পাচার রোধ, অধিকার সচেতনতা সৃষ্টি ইত্যাদি বহুবিধ কাজ রাষ্ট্র সম্পাদন করে। 

রাষ্ট্র একটি বৃহদাকার সংগঠন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ রাষ্ট্রকে মোকাবিলা করতে হয়। তবে সার্বিকভাবে জনগণের কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য । জনগণের চাহিদা অনুযায়ী বিশ্বের কল্যাণকামী রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশে রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কাজের পরিধি দিনদিন ব্যাপক ও বিস্তৃত হচ্ছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url