সার্ক || SAARC

 সার্কের গঠন ও উদ্দেশ্য 

'সার্ক' হলো দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী আটটি রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত আখালিক সহযোগিতা সংস্থার নাম হলো SAARC South Asian Associntion for Regional Couperation উল্লেখ্য , সার্ক গঠনের আগে এর নামকরণ প্রসঙ্গে ৭ টি দেশের পররাষ্ট্র সচিবগণ ৪ টি প্রস্তাব করেছিলেন । প্রস্তাবিত নামগুলো হলো: 
১. South Asian Association for Co - operation (SAAC) , 
২. Association for South Asia ( ASA ) 
৩. Association of South Asia for Co - operation (ASAC) এবং 
৪. Organization of South Asian States (OSAS)। 

১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম শীর্ষ সম্মেলনে প্রস্তাবিত নামগুলোর কোনোটিই গৃহীত হয়নি। এ সম্মেলনে সংস্থাটি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহায়তা (SARC) নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৮৫ সালের ৭ ও ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনে নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বিক্রম শাহদের SAARC নামকরণের প্রস্তাব দেন। ১৯৮৬ সালে ভারতের ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলন থেকে এ সংস্থাটি ' South Asian Association for Regional Cooperation (SAARC) নামে পরিচিত হয়। 

সার্ক গঠনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উদ্যোক্তার ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮০ সালের নভেম্বরে ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রস্তাব করে একটি সুপারিশপত্র প্রণয়ন করে। এতে বলা হয় , এ ধরনের একটি সহযোগিতার সম্ভাবনার কথা আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে বিভিন্ন রাজধানীতে বিভিন্ন সময়ে নেতৃবৃন্দ পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করে আসছে। ১৯৭৭ সাল হতে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নেপাল, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা সফরকালে এ অঞ্চলের জনগণের সামগ্রিক কল্যাণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তোলার সম্ভাবনা ব্যাখ্যা করেন। 

এ প্রচেষ্টায় আশাব্যঞ্জক সাড়া পেয়ে তিনি ভুটান, ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে চিঠি লিখে বিশেষ দূত পাঠান। অতঃপর ১৯৮১ সালে এর মূলনীতিসমূহের আলোচনা শুরু হয় এবং ১৯৮৩ সালের ২ আগস্ট দিল্লি বৈঠকে প্রকাশিত হয় সার্কের ঘোষণাপত্র। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় সার্ক সনদ স্বাক্ষরিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপ এ সনদে স্বাক্ষর করে। ২০০৭ সালে সার্কের প্রয়োদশ শীর্ষ সম্মেলনে আফগানিস্তান ৮ ম সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। সদস্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি সার্কের পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র ও সংস্থা রয়েছে। যথা— অস্ট্রেলিয়া, চীন , ইউরোপীয় ইউনিয়ন (সংস্থ্যা), জাপান, ইরান, মরিশাস, মিয়ানমার , দক্ষিণ কোরিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। 
সার্ক

সার্ক ঘোষণাপত্র 

সার্কের ঘোষণাপত্রে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের কল্যাণ ও ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে নিম্নোক্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়-
ক . সার্কভুক্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা এবং সব মানুষকে পূর্ণ মানবিক মর্যাদায় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে লাগানো।

খ. সার্কভুক্ত দেশগুলোকে যৌথ আদ্রানির্ভরতার লক্ষ্যে সহযোগী করে তোলা।

গ. সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা বৃদ্ধি করা।

ঘ. অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে দেশগুলোর সক্রিয় সহযোগিতা নিশ্চিত করা। 

ঙ. অপরাপর উন্নয়নশীল দেশের সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
 
চ. অভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম ও নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করা।

সার্কের সহযোগিতার ক্ষেত্র 

সার্কভুক্ত আটটি দেশের পররাষ্ট্র সচিবরা দিল্লি বৈঠকে মিলিত হয়ে একটি স্থায়ী কমিটি (Standing Committee) গঠন করেন । এ কমিটির ওপর পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করার দায়িত্ব অর্পিত হয়। নিচে কমিটি নির্ধারিত সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো উল্লেখ করা হলো : 
ক . প্রকল্প অনুমোদন ( Approval of Projects ), 
খ.প্রকল্পের অর্থ সংস্থান ( Project Financing ), 
গ. অগ্রাধিকার নির্ণয় ( Selection of Priorities ); 
ঘ . সম্পদ সমাবেশ ( Resource Mobilization ) এবং 
ঙ . সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র নির্ণয় ( Determination of New Fields of Cooperation)
পররাষ্ট্র সচিবদের উক্ত বৈঠক সার্কভুক্ত আটটি দেশের পরিকল্পনাসমূহের মধ্যে সহযোগিতার তাগিদ দেয় এবং এদের যৌথ কার্যক্রমের মাধ্যমে এক সমন্বিত কর্মসূচি অনুমোদন করে। 

সার্কের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো 

সার্ক সনদে এ সংস্থার পাঁচ স্তরবিশিষ্ট একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উল্লেখ রয়েছে। সেগুলো হলো : 
১. রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের শীর্ষ সম্মেলন,
২. পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেম্মলন,
৩. স্ট্যান্ডিং কমিটি ; 
৪. টেকনিক্যাল কমিটি ; 
৫. সার্ক সচিবালয়।

সার্কের মূলনীতি 

সার্কের মূলনীতিগুলো হলো : 
১. এ সংস্থার যেকোনো সিদ্ধান্ত সর্বসম্মত হবে। 

২. দ্বিপক্ষীয় বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো এ সংস্থায় তোলা হবে না।

৩. আঞ্চলিক অখণ্ডতা , সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না করার নীতি এবং পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার নীতিকে সহযোগিতার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা।

৪. এ অঞ্চলের দেশগুলোর আশা - আকাঙ্ক্ষার প্রতি লক্ষ্য রেখে সার্ক ভূমিকা গ্রহণ করবে।

 সার্কের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য 

 ‘সার্ক সনদ' এবং 'ঢাকা ঘোষণা অনুযায়ী সার্কের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে নিম্নরূপ:
১. দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের কল্যাণ সাধন ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন।

২. অর্থনৈতিক , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা , বিজ্ঞান ও কারিগরি ক্ষেত্রে সহযোগিতা দান।

৩. সার্কভুক্ত দেশসমূহের আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে যৌথ প্রচেষ্টা গ্রহণ।

৪. বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ , আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা স্থাপন ও বৃদ্ধি।
 
৫. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থ - সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও অনুকূল অবস্থান গ্রহণ। 

৬. একে অপরের সার্বভৌমত্ব , ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা ও স্বাধীনভাবে চলার নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা , অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা।

সার্ক সচিবালয় 

সার্ক সচিবালয় নেপালের রাজধানী কাঠমাভুতে অবস্থিত। ১৯৮৭ সালের ১৬ জানুয়ারি সার্ক সচিবালয়ের উদ্বোধন করা হয় । সার্ক সচিবালয়ের দায়িত্ব হচ্ছে সার্কের বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবাহন ও মনিটর করা, সংস্থার বিভিন্ন সভায় কার্যকর ভূমিকা পালন করা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সার্কের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করা। একজন সেক্রেটারি জেনারেল, ৭ জন পরিচালক এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা - কর্মচারী নিয়ে সার্ক সচিবালয় গঠিত হয়।

সার্কের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক 

সার্কের বর্তমান ৮ টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশের সাথেই সার্কের ইতিহাস সবচেয়ে নিবিড়। সার্কের সাথে এ দেশের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকার প্রথম সার্ক গঠনের উদ্যোগ নেয় ১৯৮৫ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের উদ্দ্যোগে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে সার্কের কারা শুরু হয়। 

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় সার্কের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালের ৭ ও ৮ ডিসেম্বর । এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান । পরবর্তীকালে ১৯৯৩ সালে সন্ধ্যা শীর্ষ সম্মেলন ও ২০০৫ সালে ত্রয়োদশ শীর্ষ সম্মেলনও ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় । তিনটি সসোলনেই নতুন আশাবাদ ও কার্যক্রম ঘোষণা করা হয়। সার্কের উদ্যোক্তা হিসেবে বাংলাদেশ সার্কের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বলিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সার্কের সদস্য হিসেবে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা - বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও ভারসাম্য রক্ষা , আঞ্চলিক বিরোধ নিষ্পত্তি এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান সংকট সমাধানে বাংলাদেশ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । 

এছাড়া সদস্য দেশগুলোতে মানবপাচার রোধ , সন্ত্রাস দমন , পরিবেশ সংরক্ষণ , যোগাযোগ ও প্রযুক্তির উন্নয়ন , রোগ ব্যাধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণ ইত্যাদি কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ । এসব ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতায় নানা ধরনের যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে । এগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে সার্কের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করার জন্য বাংলাদেশ সব ধরনের সহযোগিতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

সারা বিশ্বের বিভিন্ন আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে গঠিত জোট ও সংস্থাগুলোর মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হয় সার্ক ( SAARC )। পারস্পরিক সংহতি , সৌহার্দ্য , সহযোগিতা , উন্নয়ন , প্রগতি , সমৃদ্ধি ও শান্তি এসব মূলনীতিকে সামনে রেখে সার্ক গঠিত হয়েছে । ১৯৮৫ সালের ঢাকা ঘোষণার মধ্য দিয়ে যে সংস্থাটি যাত্রা শুরু করেছিল সেটি তার দীর্ঘ পথ চলার সময়ে বিভিন্ন উন্নয়ন সাধন করেছে এবং তা এ অঞ্চলের সহযোগিতার ক্ষেত্রে কাজে লেগেছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মাঝে সমান সহযোগিতার কথা বলা হলেও ভারত এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র হওয়ায় সার্কের কার্যকর মনোভাব ও উন্নয়নমুখী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দেশটির ভূমিকা সিদ্ধান্তমূলক ও অগ্রগণ্য। 

এক্ষেত্রে ভারতের কার্যক্রমের ওপর সংস্থাটির বিকশিত হয়ে ওঠা অনেকাংশে নির্ভর করে। ত্রয়োদশ সার্ক সম্মেলনে আফগানিস্তানের সদস্যপদ প্রাপ্তি এবং চীন ও জাপানের পর্যবেক্ষক দলের যোগ্যতা অর্জন সার্ককে নতুন মাত্রা দিয়েছে। নিজেদের ভুল - ত্রুট আর হিংসাত্মক মনোভাব ভুলে শুধু আঞ্চলিক স্বার্থকে বিবেচনায় এনে পারস্পরিক সহযোগিতা অর্জন করতে পারলেই সার্কের কার্যক্রমে গতি আসবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url