জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কি? || What is Genetic Engineering?

 জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং 

 প্রতিটি মানবদেহ অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষের সমন্বয়ে গঠিত এবং প্রত্যেকটি কোষের মাঝে থাকে বংশগতির প্রধান উপাদান ক্রোমোজম (Chromosome)। এই ক্রোমোজমগুলো তৈরি হয় ডিএনএ (DNA - Deoxyribo Nuclic Acid) ডাবল হেলিক্স দিয়ে। ডিএনএ ডাবল হেলিক্স হলো ডিএনএ অণুর দ্বি - সূত্রী কাঠামো , যা সাধারণত সর্পিলাকারের হয়ে থাকে এবং এর একটি সূত্র অন্যটির পরিপূরক। জীবকোষের ডিএনএ - এর ভেতরে থাকা যে ক্ষুদ্র অংশগুলো ঐ জীবের জীবনের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, তাকে জিন (Gene) বলে। 

 অর্থাৎ জীবদেহের ডিএনএ - এর বিভাজিত একক বৈশিষ্ট্যকে জিন বলা হয়। একটি ক্রোমোজোমে অসংখ্য জিন থাকতে পারে এবং প্রতিটি মানবদেহে এরকম ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার জিন রয়েছে। 

 কোনো জীবকোষে বিদ্যমান ক্রোমোজোমে উপস্থিত জিনের সমষ্টিকে জিনোম (Genome) বলা হয়। জিনোম হলো জীবের বৈশিষ্ট্যের নকশা বা বিন্যাস। এটিকে জীবদেহের নীলনকশা বা ব্লুপ্রিন্ট বলা হয়। অন্যকথায়, কোনো জীবদেহের কোষের সম্পূর্ণ ডিএনএ বিন্যাসের ক্রমকে ঐ জীবের জিনোম সিকোয়েন্স বলে। একটি জীবের জিনোম সিকোয়েন্সের ওপর ঐ জীবের (প্রাণী বা উদ্ভিদের) বৈশিষ্ট্য কিরূপ হবে তা নির্ভর করে। জিনোম সিকোয়েন্স যত দীর্ঘ হবে, এর ধারণ করা তথ্যও তত বেশি হবে। কোনো জীব থেকে একটি নির্দিষ্ট জিন (Gene) বহনকারী DNA পৃথক করে ভিন্ন একটি জীবে স্থানান্তরের কৌশলকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বলে। 

 অথবা , জীন/ডিএনএ পরিবর্তন করার কৌশলকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বলে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং মূলত ট্রান্সজেনিক (উন্নত বৈশিষ্ট্যধারী) উদ্ভিদ ও প্রাণী সৃষ্টিতে কাজ করে। 

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর মাধ্যমে জীবদেহে জিনোমকে প্রয়োজন অনুযায়ী সাজানো বা একাধিক জীবের জিনোমকে জোড়া লাগিয়ে নতুন জীবকোষ সৃষ্টি করা যায়। যেহেতু জিন হচ্ছে প্রতিটি জীবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বাহক, তাই জিনোমের কোনো জিনকে পরিবর্তন করে ঐ জীবের কোনো বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা যায়। জিন ডিএনএ - এর একটি অংশ হবার কারণে ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ - এর সেই অংশটুকু কেটে আলাদা করে অন্য কোনো প্রাণী বা ব্যাকটেরিয়া থেকে আরেকটি জিন কেটে এনে সেখানে লাগিয়ে দিতে হয়। ১৯৭০ সালে আণবিক কাঁচি নামে সমাদৃত রেস্ট্রিকশন এনজাইম (যা দিয়ে ডিএনএ অণু কাটা যায়) আবিষ্কারের পর মূলভ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর যাত্রা শুরু হয়। 

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এ গবেষণার মাধ্যমে যখন একটি জিন পরিবর্তন করে সেখানে অন্য জিন লাগানো হয়, তখন তাদেরকে একত্রে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ বা RDNA প্রযুক্তি বলে। এ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে DNA সূত্রের কাঙ্ক্ষিত খণ্ড বা অংশ ক্ষুদ্র এককোষী আবাদি জীব তথা ব্যাকটেরিয়া থেকে মানবদেহে , উদ্ভিদকোষ থেকে প্রাণীদেহে এবং প্রাণীকোষ থেকে উদ্ভিদদেহে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়েছে। 

আর এ কাজ সফল করতে কোনো এক জীবের DNA (জেনেটিক পদার্থ) -কে এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়, যাতে তার নিজস্ব জিনের কাজ করার ক্ষমতা লোপ পায় কিংবা ভিন্ন কোনো জীবের জেনেটিক পদার্থের সাথে মিশে নতুন জিন বা বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে। এসব RDNA সমৃদ্ধ জীবকোষকে বলা হয় Genetically Modified Organism (GMO)। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই অসংখ্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও ঔষধ কোম্পানি রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি সফলভাবে প্রয়োগ করে বাণিজ্যিক সুবিধাদি গ্রহণ করছে। উদাহরণস্বরূপ মানবদেহের ইনসুলিন তৈরির জিনকে ব্যাকটেরিয়া কোষে প্রবিষ্ট করে বাণিজ্যিকভাবে ইনসুলিন তৈরি করা হচ্ছে। 

তাছাড়া রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কৃষিজাত ফসল এবং উদ্ভিদের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। এসব জাতকে ট্রান্সজেনিক (Transgenic) উদ্ভিদ বলে। ১৯৭২ সালে Paul Borg বানরের ভাইরাস SV40 lambda virus- এর ডিএনএ - এর সংযোগ ঘটিয়ে বিশ্বের প্রথম রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ অণু তৈরি করেন। ১৯৭৩ সালে E.coli ব্যাকটেরিয়ার প্লাসমিডের মধ্যে এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্ট জিন প্রবেশ করানোর মাধ্যমে Herbert Boyer এবং Stanley Cohen সর্বপ্রথম ট্রান্সজেনিক জীব তৈরি করেন।

রিকম্বিনেন্ট DNA বা RDNA প্রযুক্তির ধাপসমূহ 

১. DNA নির্বাচন: উদ্ভিদের কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য বহনকারী DNA কে নির্বাচন করা হয়। 

২. DNA- এর বাহক নির্বাচন: নির্বাচিত DNA- কে বহন করার জন্য বাহক হিসেবে E.coli- কে নির্বাচন করা হয়। এ বাহকের প্লাজমিডকে DNA- র সাথে যুক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। ব্যাকটেরিয়ার দেহে সাধারণ DNA অণু ছাড়াও অতিরিক্ত স্বনিয়ন্ত্রিত বৃত্তাকার যে DNA থাকে , তাকে প্লাজমিড বলে। 

৩. DNA ও কর্তন: নির্দিষ্ট রেস্ট্রিকশন এনজাইম ব্যবহার করে নির্বাচিত DNA হতে সুবিধামতো DNA অংশটি কেটে নিতে হয়। 

৪. কর্তনকৃত DNA অণ্ড প্রতিস্থাপন: কর্তনকৃত DNA খণ্ডে লাইগেজ এনজাইম প্রয়োগ করে প্লাজমিড DNA- এর যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করা হয়। পরিবর্তনকৃত প্লাজমিড DNA- কে রিকম্বিনেন্ট বলে। 

৫. পোষকদেহে রিকম্বিনেন্ট DNA স্থানান্তর: রিকম্বিনেন্ট DNA অণুকে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে পোষক ব্যাকটেরিয়ার DNA গ্রহণকারী দেহে প্রবেশ করানো হয়। ব্যাকটেরিয়াকে ট্রান্সফর্মড ব্যাকটেরিয়া বলে। 

৬. রিকম্বিনেন্ট DNA- র সংখ্যা বৃদ্ধি ও মূল্যায়ন: রিকম্বিনেন্ট DNA ব্যাকটেরিয়াকে কালচার মিডিয়ামে রেখে সংখ্যা বৃদ্ধি করানো হয়। এ সময় কাঙ্ক্ষিত জিনবাহী প্লাজমিডও পোষক কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। এভাবে পোষকদেহে অধিক রিকম্বিনেন্ট DNA সৃষ্টি হয়। 

জ্যাক উইলিয়ামসন (Jack Williamson) (1908-2006): প্রখ্যাত আমেরিকান সায়েন্স ফিকশন রাইটার। তাঁর প্রকৃত নাম জন স্টুয়ার্ট উইলিয়ামসন হলেও তিনি লেখালেখি করতেন জ্যাক উইলিয়ামসন নামে। তার লেখা ড্রাগনস আইল্যান্ড নামক সায়েন্স ফিকশনে সর্বপ্রথম জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং টার্মটি ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে আধুনিক বিজ্ঞানে এর সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। 

ট্রান্সজেনিক: কোনো জিন বা জেনেটিক ম্যাটেরিয়ালকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং দ্বারা এক টাইপ অর্গাজম থেকে অপর টাইপ অর্গাজমে পরিবর্তিত করাকে ট্রান্সজেনিক বলা হয়। ডিএনএকে কাটা ও সংযোজনের পদ্ধতি তথা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং আবিষ্কারের পর এর মাধ্যমে জেনেটিক কারিগরিতে বিভিন্ন ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ বা প্রাণী তৈরি করা সম্ভব হয়ে ওঠে।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহারের উদাহরণ: প্রচণ্ড ঠান্ডা পরিবেশ টমেটো উৎপাদনের জন্য প্রতিকূল। এ পরিবেশে টমেটোর ফলন কম হয়। অন্যদিকে মাছ অনেক ঠান্ডা পরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্যে টিকে থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা কোন জিনের কারণে মাছ অত্যন্ত ঠান্ডা প্রতিরোধ করতে পারে, তা শনাক্ত করে জেনেটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে টমেটোতে এ এন্টি - ফ্রিজ (ঠান্ডা প্রতিরোধক) জিনকে সন্নিবেশিত করে নতুন জাতের টমেটো আবিষ্কার করেছেন। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর সফল প্রয়োগের মাধ্যমে আজকাল মিষ্টি টমেটোও উৎপাদন করা যাচ্ছে। এভাবে প্রচণ্ড শীতের প্রতিকূল পরিবেশেও টমেটোর ফলন বাড়ানো যায়। বর্তমানে কৃষিতে উন্নত জাতের ফলনের জন্য জেনেটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের হাইব্রিড ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কৃষি ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করে থাকে। যেমন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে আণুবীক্ষণিক জীব তথা- ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট অথবা ইনসেক্ট ম্যামালিয়ান সেল ইত্যাদি থেকে বাণিজ্যিকভাবে প্রোটিন উৎপাদন করা যায়। বাণিজ্যিকভাবে পাউরুটি উৎপাদনে ইস্ট ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়াও কৃষি, খাদ্য ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। 

কৃষিতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর প্রায়োগিক গুরুত্ব

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর মূল গবেষণা কৃষিকে ঘিরে। এর সাহায্যে Genetically modified crops উৎপন্ন করা হয়, যা উচ্চফলনশীল, উন্নত জাতের, প্রকৃতি সহনশীল এবং রোগজীবাণু থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। এই বিষয়টি হাইব্রিড নামে বহুল পরিচিত। কৃষিতে Genetically modified crops উৎপাদনে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তিটি কৃষি সম্পদ উন্নয়নে যে ভূমিকা রাখতে পারে, সেগুলো হলো-

১. পরিবেশের বিভিন্ন হুমকি বা প্রতিকূলতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে যেমন, অতিরিক্ত শীত সহ্য করা, পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত না হওয়া, ভাইরাস ও ফাংগাস দ্বারা আক্রান্ত না হওয়া ইত্যাদি সক্ষমতাসম্পন্ন উন্নত বীজ উৎপাদনসহ মাটির লবণাক্ততা সহ্য করার মধ্য দিয়ে উন্নত ফসল নিশ্চিত করা। 

২. ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়াকে (Bacteria) ধ্বংস করার মাধ্যমে উন্নত কৃষিপণ্য (Agricultural products) উৎপাদনের পরিবেশ নিশ্চিত করা। 

৩. শস্যের গুণগত মান বৃদ্ধি করা এবং অধিক ফলনশীল শস্য উৎপাদন করা। যেমন: Amflora potato. 

৪. খরা, বৃষ্টি সহনশীল ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন স্বল্প সেচের প্রয়োজন হয় এমন শস্যের জাত উদ্ভাবন করা। উপর্যুক্ত সবগুলো কার্যক্রমই উন্নত কৃষি সম্পদকে নিশ্চিত করে বিধায় কৃষি সম্পদ উন্নয়নে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তির ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। 

প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর প্রায়োগিক গুরুত্ব 

Genetic Engineering ব্যবহার করে মানুষের প্রয়োজন মেটাতে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে এর প্রায়োগিক গুরুত্বসমূহ হলো-
১. জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে উন্নত প্রজাতির গরু উৎপাদন কিংবা সাধারণ গরুকে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে জেনেটিক্যালি মডিফাই করে অধিক মোটাতাজা করে তোলা যায়। এ ধরনের গরু অধিক মাংসের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অধিক দুধ প্রদানেও সক্ষম হয়ে থাকে। 
২. অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের জেনেটিক বিজ্ঞানীগণ মহিষের জিনতত্ত্ব বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর জীবনরহস্য উদ্ঘাটনে সফল হয়েছেন। এর ফলে এখন উন্নত প্রজাতির মহিষ উৎপাদন সম্ভব, যা আমাদের কৃষিকাজে ব্যাপক সহায়ক হতে পারে। আমাদের দুগ্ধের চাহিদা মেটাতেও এ ধরনের মহিষ কার্যকর হতে পারে।

 জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এ ICT-এর প্রয়োগ 

 ১. জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এ গবেষণার তথ্য ও ফলাফল গবেষকদের মধ্যে আদান - প্রদান ও মতবিনিময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহৃত হয়। 

 ২. বিভিন্ন প্রাণীর জিনের তথ্য এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল সংরক্ষণ করার জন্য ডেটাবেজ (Database) ব্যবহৃত হয়। 

 ৩. এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধাপে কম্পিউটার (Computer) নিয়ন্ত্রিত বিশেষ জটিল সিস্টেম (System) ব্যবহৃত হয়। 

 ৪. জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রক্রিয়ায় গবেষণার জন্য কম্পিউটার সিম্যুলেশন (Computer Simulation) ব্যবহৃত হতে পারে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url