বিশ্বগ্রাম কি? || what is global village?
বিশ্বগ্রাম
গ্রামের সকল মানুষ একে অপরকে চেনে এবং প্রতিটি গ্রামের সংযোগ কাছাকাছি হওয়ায় এবং সেখানকার বসবাসকারী সকল মানুষ খুব সহজে তাদের বিভিন্ন দৈনন্দিন প্রয়োজনে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। গ্রামে কোনো একটি বিষয়ে আলোচনা হলে মুহূর্তের মধ্যে তা একে অপরের মাধ্যমে জানাজানি হয়ে যায়। তেমনি বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে মুহূর্তেই এক দেশের গ্রামের খবর অন্য দেশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই বিশ্বের প্রতিটি গ্রামের বসবাসকারীরা তাদের সুখ - দুঃখ, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিষয়ের খবরাখবর একে অপরের সাথে বিনিময় করছে এবং একে অপরের পাশাপাশি থাকছে। আর এভাবেই তারা প্রযুক্তির সাহায্যে বিশ্বগ্রাম তৈরি করেছে।
বর্তমানে আমরা আমাদের অনুভূতিকে স্বল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের কাছে পৌছাতে পারছি। অনুরূপভাবে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষগুলো তাদের অনুভূতি আমাদের কাছে পৌছাতে পারছে। ফলে উভয়ের মধ্যে একটি কমিউনিটি তৈরি হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী স্বল্প সময়ে এই যোগাযোগ সুবিধার ফলে বিশ্বকে একটি গ্রাম হিসেবে তুলনা করা হচ্ছে । এজন্য বর্তমান বিশ্বকে গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রাম বলা হয়।
বিশ্বগ্রামের প্রথম ধারণা প্রদানকারী
কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিখ্যাত দার্শনিক, যোগাযোগ তত্ত্ববিদ হারবার্ট মার্শাল ম্যাকলুহান (Herbert Marshall McLuhan) ১৯৬২ সালে The Gutenberg Galaxy ও ১৯৬৪ সালে Understanding Media নামক দুটি বইয়ে সর্বপ্রথম গ্লোবাল ভিলেজ কথাটি ব্যবহার করেন। এজন্য তাকে বিশ্বগ্রামের জনক বলা হয়। বিশ্বগ্রামের মূল কথা হলো বর্তমান বিশ্বকে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি গ্রামে পরিণত করা। ম্যাকলুহান ১৯১১ সালের ২১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন ও ১৯৮০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মৃতুবরণ করেন।
বিশ্বগ্রাম হচ্ছে এমন একটি সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা, যেখানে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষই একটি একক সমাজে বসবাস করে ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজেই তাদের চিন্তা চেতনা, অভিজ্ঞতা , সংস্কৃতি - কৃষ্টি ইত্যাদি বিনিময় করতে পারে এবং একে অপরকে সেবা প্রদান করে থাকে। www আবিষ্কারের অনেক পূর্বেই Global Village শব্দের ধারণা পাওয়া যায়।
বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে বসে এখন যোগাযোগ হচ্ছে। Zoom , Skype, Tango, Viber, IMO, Google Duo, WhatsApp , Amazon Alexa , Facebook , Messenger, Myspace ও Twitter এর মাধ্যমে যোগাযোগ করে মানুষ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা - গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। মূলত ইলেকট্রনিক টেকনোলজির মাধ্যমে বিশ্বগ্রাম তৈরিতে ক্রমবর্ধমান উন্নতি সাধন হচ্ছে।
বিশ্বগ্রামের সুবিধাসমূহ
২. ভিডিও (Video) কলের মাধ্যমে সরাসরি কথা বলা যায়।
৩ . আর্থিক লেন - দেন করা যায়।
৪. বিদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিভিন্ন তথ্য জানা যায়।
৫. যেকোনো দেশের শিল্প , সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়।
৬. ভৌগেলিক সীমানা (Geographical boundaries) ও অর্থনৈতিক (Economic) বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা যায়।
৭. বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির বই অনলাইনের মাধ্যমে সংগ্রহ করা যায়া।
৮. ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো যায়।
৯. বিনোদন ও খেলাধুলা সম্পর্কিত তথ্য জানা যায়।
১০. ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের সাথে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বজায় রাখা যায়।
১১. পৃথিবীর নামকরা চিকিৎসকের চিকিৎসাসেবা ঘরে বসেই নেওয়া যায়।
১২. ইন্টারনেট - এর মাধ্যমে ঘরে বসেই আউটসোর্সিং করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়।
১৩. বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠার ফলে এক দেশের খবর অন্য দেশের ঘরে বসেই দেখা যায়।
১৪. ব্যবস্থাপনা খরচ অনেক কম।
বিশ্বগ্রামের অসুবিধাসমূহ
২. ইন্টারনেট হ্যাকিং তথা সাইবার ক্রাইমের কারণে তথ্যের গোপনীয়তা নষ্ট হয়।
৩. মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করে রাষ্ট্রের মধ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে।
৪. বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন ইন্টারনেট ব্যবহার করে গোপন যোগাযোগ করে রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধন করে।
৫ . এক দেশের সংস্কৃতি (Culture) অন্য দেশের জন্য ক্ষতিকর (Harmful) হতে পারে।
৬. ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগের ফলে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে।
৭. বিশ্বগ্রামের ফলে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর গোপন তথ্য বা নথি প্রকাশের ফলে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা নষ্ট হয়।
৮. ইন্টারনেট ব্যবহার করে কাউকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা।
৯. আর্থিক লেনদেনের তথ্য চুরি করে গ্রাহকগণের ক্ষতি করা।
১০. ইন্টারনেট বেশি ব্যবহারের ফলে আসক্তি জন্মায়।
১১. অন্যের গবেষণার তথ্য (Research data) সংগ্রহ করে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া।
১২. প্রযুক্তি (Technology) ব্যাপক ব্যবহারের ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়া।
বিশ্বগ্রাম সংশ্লিষ্ট উপাদানসমূহ
২. প্রোগ্রামসমূহ বা সফটওয়্যার,
৩. ব্যক্তিবর্গের সক্ষমতা,
৪. ডেটা বা ইনফরমেশন,
৫. ইন্টারনেট সংযুক্ততা।
১. হার্ডওয়্যার বা কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি (Hardware): হার্ডওয়্যার বলতে কম্পিউটারের সমস্ত ফিজিক্যাল ইলেকট্রনিক উপাদানকে বোঝায়। যেমন- বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড, ডিসপ্লে ও প্রিন্টার। বিশ্বগ্রামে যেকোনো ধরনের যোগাযোগ ও তথ্য আদান - প্রদানের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও কম্পিউটারের সাথে মোবাইল ফোন, স্মার্ট ফোন, অডিও ভিডিও রেকর্ডার, ওয়েবক্যাম, স্যাটেলাইট, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি হার্ডওয়্যারের অন্তর্ভূক্ত।
২. প্রোগ্রামসমূহ বা সফটওয়্যার (Software): কম্পিউটারকে কার্যোপযোগী করা ও কম্পিউটার দ্বারা কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যবহৃত প্রোগ্রামসমূহকে সফটওয়্যার বলে। বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠার জন্য হার্ডওয়্যারের পাশাপাশি সফটওয়্যার প্রয়োজন। সফটওয়্যারের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের Operating System, Browsing Software, Communicating Software, Programming Language ইত্যাদি।
৩ . ব্যক্তিবর্গের সক্ষমতা (Human capacity): বিশ্বগ্রামের উপাদানের মধ্যে ব্যক্তিবর্গের সক্ষমতা অন্যতম। ICT নির্ভর বিভিন্ন প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান ও ধারণা থাকা আবশ্যক। যেমন- সফটওয়্যার তৈরির সক্ষমতা ও এর ব্যবহার।
৪ . ডেটা বা ইনফরমেশন (Data or Information): ডেটা বা উপাত্ত হলো তথ্যের উপাদান। ডেটা হচ্ছে তথ্যের মৌলিক ধারণা যা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তথ্য তৈরি হয়। এটি অঙ্ক, বর্ণনা, টেক্সট, ইমেজ, অডিও ভিডিও এমনকি গ্রাফও হতে পারে। বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠায় ডেটা প্রসেসিং করে মানুষের কল্যাণে তথ্যে পরিণত করা হয় । বিশ্বগ্রাম সৃষ্টিতে ডেটা আদান - প্রদান অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫. ইন্টারনেট সংযুক্ততা (Internet Connectivity): ইন্টারনেট সংযুক্ততা ছাড়া বিশ্বগ্রাম প্রায় অসম্ভব। এ কারণেই ইন্টারনেটকে বিশ্বগ্রামের মেরুদণ্ড বলা হয়। ইন্টারনেটের কারণে আজ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যোগাযোগ করা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে টেলিকমিউনিকেশন, ব্রডকাস্টিং ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইন্টারনেট কানেকশন দেয়ার ব্যবস্থা হয়ে থাকে।