সমাজবিজ্ঞান কাকে বলে? || What is sociology?

সমাজবিজ্ঞান কি?

সমাজবিজ্ঞান সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের (রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজকল্যাণ, নৃ - বিজ্ঞান ইত্যাদি) অন্যতম যার প্রধান আলোচ্য বিষয় সমাজ। তাই সমাজের বিজ্ঞান হিসেবেই এর পরিচয়। মূলত সমাজে বসবাসকারী মানুষের পারস্পরিক যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন থেকেই সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব হয়েছিল। 

১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি সমাজচিন্তাবিদ ও দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎ (Auguste Comte) তাঁর 'Positive Philosophy' গ্রন্থে সর্বপ্রথম সমাজবিজ্ঞান (Sociology) শব্দটি ব্যবহার করেন। সমাজকে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনে কোঁৎ যে নতুন বিজ্ঞানের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন তাকে তিনি প্রথমে 'সামাজিক পদার্থবিদ্যা' (Social physics) বলতে আগ্রহী ছিলেন। 

কিন্তু সে সময় বিখ্যাত বেলজিয়ান পরিসংখ্যানবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডলফ কুয়েটলেট (Adolphe Quetelet) সমাজের সংখ্যাবাচক বিশ্লেষণের বর্ণনায় 'Social Physics' শব্দটি ব্যবহার করার কারণে কোঁৎ ভিন্ন একটি শব্দের খোঁজ করেন। অবশেষে তিনি 'Sociology' শব্দটি বেছে নেন। 'Sociology' শব্দটি ল্যাটিন 'Socius' এবং গ্রিক ‘Logos' শব্দের সমন্বয়ে সৃষ্ট। 'Socius' শব্দের অর্থ সঙ্গী (Companion)। যেহেতু সঙ্গী - সাথী মিলে সমাজ গড়ে ওঠে সেহেতু পরোক্ষভাবে এর মানে হচ্ছে সমাজ। অন্যদিকে 'Logos' শব্দটির অর্থ অধ্যয়ন বা বিজ্ঞান (Study or Science)। 

সুতরাং শাব্দিকভাবে সমাজবিজ্ঞান জ্ঞানের সেই শাখা যা সাধারণীকরণ বা বিমূর্তায়ন পর্যায়ে সমাজ সম্পর্কে আলোচনা করে। বস্তুত সমাজবিজ্ঞানের সর্বজনীন সংজ্ঞা প্রদানে এখনও পর্যন্ত সমাজতাত্ত্বিকরা ঐকমত্যে পৌছতে পারেননি। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমন- ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম (Emile Durkheim) সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, "সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান" (Science of institutions)। সংজ্ঞাটিতে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। 

সমাজবিজ্ঞান

অন্যদিকে জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber ) তার 'Economy and Society' গ্রন্থে বলেন, "সমাজবিজ্ঞান এমন এক বিজ্ঞান যা সামাজিক কার্যাবলিগুলোর কার্য - কারণ ও প্রতিক্রিয়ার ব্যাখ্যা দেওয়ার লক্ষ্যে এগুলোকে বিশ্লেষণের কাজে নিয়োজিত।" এ সংজ্ঞায় দেখা যাচ্ছে যে, ওয়েবার সামাজিক কার্যাবলির ওপর জোর দিয়েছেন।

আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট এম . ম্যাকাইভার (Robert Morrison Maclver) ও চার্লস এইচ. পেজ (Charles Harrison Page) তাদের 'Society : An Introductory Analysis' গ্রন্থে বলেন, 'সমাজবিজ্ঞান মানুষের সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে, যে সম্পর্কের জালকে আমরা সমাজ বলি' (Sociology deals with man's Social relationship , the network of relationship we call society)। এখানে দেখা যাচ্ছে , ম্যাকাইভার ও পেজ তাঁদের সংজ্ঞায় গুরুত্ব দিয়েছেন সামাজিক সম্পর্কের ওপর। ম্যাকাইভার ও পেজের মতকে সমর্থন করে আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী জন এফ. কিউবার (John Frank Cuber) বলেন , মানব সম্পর্কের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান হলো সমাজবিজ্ঞান। 

আবার আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী আর টি শেফার (Richard T. Schaefer) তার 'Sociology' গ্রন্থে বলেন, 'Sociology is the systematic study of social behavior and human groups.' অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞান হলো সামাজিক আচরণ ও মানুষের গোষ্ঠীসমূহের পরিকল্পিত পাঠ। এছাড়া ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী মরিস গিন্সবার্গ (Morris Ginsberg) ব্যাপক অর্থে সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে মানবিক ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়া ও সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি তার ‘Sociology' গ্রন্থে বলেন, সমাজবিজ্ঞান এর সবচেয়ে ব্যাপক অর্থে মানবসমাজের পারস্পরিক ক্রিয়া , আন্তঃসম্পর্ক এবং এগুলোর অবস্থা ও পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করে (In the broadest sense , sociology is the study of human inter actions and inter relations , their conditions and consequences)। 

বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী প্রদত্ত এ সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করে সমাজবিজ্ঞানের কার্যকর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা যায়, সমাজবিজ্ঞান এমন একটি শাস্ত্র যা বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান, ক্রিয়া এবং মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পিত বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান করে।

সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি 

সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি নির্ণয় করতে হলে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের সাথে এর সম্পর্ক নির্ণয়ের পাশাপাশি শাস্ত্রটির অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর ওপরও নজর দিতে হবে। 
ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী টি . বি . বটোমোর (T. B. Bottomore) বলেন, “সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি প্রচলিত বিতর্ক এর প্রকৃতি নিয়ে। একদল সমাজতাত্ত্বিক একে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অনুরূপ মনে করেন। অন্য একদলের মতে , এটি একটি স্বতন্ত্র বিষয় , ইতিহাস কিংবা দর্শনের সাথেই যার বেশি মিল। " সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি সম্পর্কে আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট বার্স্টেড (Robert Bierstedt) তার 'The Social Order' গ্রন্থে কতকগুলো প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। এগুলো হচ্ছে— 
১. সমাজবিজ্ঞান সামাজিক বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নয়। 
২. সমাজবিজ্ঞান বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান, আদর্শ বিজ্ঞান নয়।
৩. সমাজবিজ্ঞান তাত্ত্বিক বিজ্ঞান, ব্যবহারিক বিজ্ঞান নয়। 
৪. সমাজবিজ্ঞান (Sociology) তুলনামূলকভাবে বিমূর্ত বিজ্ঞান (Abstract science), সুনির্দিষ্ট ঘটনা নয়। 
৫. সমাজবিজ্ঞান সাধারণ বিজ্ঞান, বিশেষ কোনো বিজ্ঞান নয় । বস্তুত সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি এর বিভিন্ন সংজ্ঞা বিশ্লেষণের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। বিভিন্ন সংজ্ঞা পর্যালোচনা করে সমাজবিজ্ঞানের যে প্রকৃতি নির্ণয় করা যায় তা নিচে উল্লেখ করা হলো-

সামাজিক সম্পর্কের বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ ( Scientific study of social relationship ): মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে সমাজ গড়ে ওঠে। এজন্য সমাজবিজ্ঞান সামাজিক মানুষের আচার - আচরণ, আদর্শ - মূল্যবোধ, কার্যাবলি, রীতিনীতি কীভাবে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং কীভাবে এর গতিশীলতা বজায় থাকে তা নিয়ে অধ্যয়ন করতে গিয়ে গোটা সমাজের মধ্যেই এর অনুসন্ধান করে। 

সমাজ সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ পাঠ (Complete study of society): সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য বিষয় (রাষ্ট্রবিজ্ঞান , অর্থনীতি , সমাজকল্যাণ , নৃবিজ্ঞান ইত্যাদি) সমাজের এক একটি বিশেষ দিক নিয়ে আলোচনা করে। এসব সামাজিক বিজ্ঞানের কোনোটিই সমাজ সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ অধ্যয়নের দাবি করতে পারে না। পক্ষান্তরে গোটা সমাজই সমাজবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয় বা ক্ষেত্র । তাই বলা যায় , সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে সমাজ সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ পাঠ।

সমাজকাঠামোর অধ্যয়ন (Study of social structure): সমাজকাঠামো সমাজবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় প্রত্যয়। আর সমাজকাঠামোর মূল ভিত্তি হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। বস্তুত মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও কাঠামোর দ্বারাই সুশৃঙ্খলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় । এজন্য ব্যক্তি, গোষ্ঠী, প্রথা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে সমাজবিজ্ঞান আলোচনা করে। এ কারণে বলা হয় যে, সমাজবিজ্ঞান হলো সমাজকাঠামো সম্পর্কিত বিশেষ অধ্যয়ন। 

সমাজের বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ (Scientific study of society): সমাজবিজ্ঞান মানবসমাজের পারস্পরিক ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক উপায় অবলম্বন করে, যার প্রেক্ষিতে তার ব্যাখ্যা হয় তথ্যনির্ভর ও যুক্তিভিত্তিক সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতির ফলে মানব আচরণে ও ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়ার মধ্যে যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে তারও সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা সমাজবিজ্ঞান প্রদান করে। কার্যত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমাজবিজ্ঞান ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করে।

প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নয় (Not natural science): সমাজবিজ্ঞান সামাজিক বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত। এটি ভৌত বা প্রাকৃতিক, বিজ্ঞানের (রসায়নবিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান ইত্যাদি) মতো নয়। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয়বস্তুকে যেভাবে পরীক্ষা - নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে , সমাজবিজ্ঞান সেভাবে করতে পারে না । তবে সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্রকে প্রয়োগ করে । ফলে এর বিষয়বস্তু বাস্তবসম্মত ও তথ্যনির্ভর হয়। 

তাত্ত্বিক বিজ্ঞান (Theoretical science): সমাজবিজ্ঞান পুর প্রকৌশল, স্থাপত্যবিদ্যা বা কম্পিউটার বিজ্ঞানের মতো ব্যবহারিক শাস্ত্র নয় । একে পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র বা গণিতশাস্ত্রের মতো একটি তাত্ত্বিক বিজ্ঞান হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে । সমাজবিজ্ঞানীরা গবেষণার দ্বারা নিত্যনতুন তত্ত্ব আবিষ্কারের সাথে সাথে পুরোনো তত্ত্বের সম্প্রসারণ বা পরিমার্জনের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটান, যেখানে ব্যবহারিক বিষয়ের চেয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটানোই থাকে মূল লক্ষ্য। 

সর্বজনীন সমাজ পাঠ (Studying universal society): বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে সমাজবিজ্ঞানে যে শৃঙ্খলিত জ্ঞান , সাধারণ সূত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়, সেগুলো ভবিষ্যতে অনুরূপ অবস্থায় নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করা যায়। এ জন্য একে সর্বজনীন সমাজ পাঠ বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, গ্রামীণ জীবনে ক্ষমতা কাঠামো , মর্যাদা ও শ্রেণিসম্পর্ক, অপরাধ, দুর্নীতি, পরিবার পরিকল্পনা, আত্মহত্যা ইত্যাদি সম্পর্কে সামাজিক সিদ্ধান্তগুলো মোটামুটিভাবে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত সব দেশের গ্রামের ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য। 

বিশ্লেষণধর্মী বিজ্ঞান (Analytical science): সমাজবিজ্ঞান কেবল সমাজের ঘটনাবলির আলোচনাই করে না বরং ওই ঘটনাসমূহের কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টাও চালায়। এক্ষেত্রে যৌক্তিক বিচার - বিশ্লেষণের সহায়তা নেয়া হয়। তাই বলা হয়, সমাজবিজ্ঞান একটি বিশ্লেষণধর্মী বিজ্ঞান। 

বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান (Objective science): বস্তুনিষ্ঠতা সমাজবিজ্ঞানীর জন্য একটি অবশ্য পালনীয় বিধি হিসেবে গণ্য করা হয়। সমাজবিজ্ঞান বিভিন্ন সামাজিক ঘটনাবলির কার্যকরণ সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে নির্মোহভাবে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা - বিশ্লেষণ দেওয়ার চেষ্টা করে। এ প্রসঙ্গে আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী কিউবার (J. F. Cuber) বলেন, “বস্তুনিষ্ঠতার পথে যেহেতু মূল্যবোধ একটা বাধা হিসেবে স্বীকৃত, সেহেতু কার্যক্ষেত্রে তা থেকে দূরে থাকার চেষ্টাটিকে আদর্শিকভাবে মেনে নেয়া উচিত, যদিও বাস্তবে তা সবসময় সম্ভব নাও হতে পারে।

মূল্যবোধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান (Value free Science): সমাজবিজ্ঞান তার বৈজ্ঞানিক চরিত্র বজায় রাখতে গিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সমাজবিজ্ঞান অন্যতম সামাজিক সমস্যা নিরক্ষরতার কারণ উদ্ঘাটন করে, কিন্তু এ সমস্যার জন্য কে দায়ী সে সম্পর্কে মতামত দেয় না। এ কারণে সমাজবিজ্ঞানকে মূল্যবোধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান হিসেবে গণ্য করা হয়। 

সামাজিক স্থিতিশীলতা ও গতিশীলতার বিজ্ঞান (Social statics and dynamics): সমাজবিজ্ঞান একই সাথে সামাজিক স্থিতিশীলতা ও গতিশীলতার বিজ্ঞান। ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎ - এর মতে, সমাজের স্থিতিশীলতা বর্ণনা মানে পরিবার, ধর্ম, শিক্ষা, বিবাহ, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি স্থায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনা । অন্যদিকে সামাজিক গতিশীলতা বিশ্লেষণ মানে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান কীভাবে কালের পরিক্রমায় উন্নত ও পরিবর্তিত হচ্ছে তার আলোচনা। শাস্ত্র হিসেবে সমাজবিজ্ঞান এ দুটো পারস্পরিক বিপরীত বিষয় নিয়েই আলোচনা করে। 

বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক শাস্ত্র (Realistic and rational discipline): শাস্ত্র হিসেবে সমাজবিজ্ঞান বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। এমন কোনো আলোচ্য বিষয় পাওয়া যাবে না যেখানে সমাজবিজ্ঞান বাস্তবতা বিবর্জিত বিশ্লেষণ করেছে। এ জন্যই দেখা যায়, বিভিন্ন দার্শনিক (প্লেটো, টমাস ম্যুর, ম্যাকিয়াভেলি প্রমুখ) ‘ইউটোপিয়া’ বা কাল্পনিক আদর্শ সমাজের যেসব ধারণা প্রদান করেছেন তা সমাজবিজ্ঞান গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেনি। উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে সমাজবিজ্ঞান একটি ভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বৈজ্ঞানিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত, যা শাস্ত্রটির প্রকৃতির মধ্যেই সুস্পষ্ট।

সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশ

বলা হয় কিছু মানবিক, নৈতিক মতবাদ ও প্রকৃতির সংমিশ্রণই সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তির কারণ। অনেকের মতে, দু'টি বিশেষ প্রবৃত্তি- সংস্কারের ও সমাজ উন্নতির প্রতি আগ্রহ এবং ইতিহাস দর্শনের প্রতি কৌতুহল থেকে সমাজবিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে সমাজবিজ্ঞান রাষ্ট্রীয় দর্শন, ইতিহাসের দর্শন, জীববিজ্ঞানের বিবর্তনবাদ এবং সামাজিক জরিপ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। 
তবে সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভবের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। 

কিন্তু সমাজব্যবস্থা ও সমাজজীবনকে জানার ও বুঝার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে চিন্তার আদি উন্মেষ থেকে। সমাজ সম্পর্কে চিন্তা ভাবনার ইতিহাস সমাজের মতোই প্রাচীন। মূলত সমাজজীবনের সমস্যা সম্পর্কিত চিন্তা - ভাবনার সূত্রেই আবির্ভাব ঘটেছে সমাজবিজ্ঞানের। তবে শুরুর দিকে মুখ্য বিষয় হিসেবে নয় বরং আনুসঙ্গিক বিষয় হিসেবেই সমাজ সম্পর্কিত চিন্তা - ভাবনা শুরু হয়েছিল। আর একটি আলাদা বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের জন্ম মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পাশ্চাত্য শিল্প বিপ্লব ও রাজনৈতিক সামাজিক বিপ্লবের যুগে। 

একটি আলাদা বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠায় কয়েকজন বিশেষ চিন্তাবিদদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান রয়েছে : 
গ্রিক দার্শনিক (Greek philosopher): পাশ্চাত্য সমাজে সর্বপ্রথম গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে সমাজ সম্পর্কে ধারাবাহিক চিন্তা চেতনা ও বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা লক্ষ করা যায়। মানব চিন্তার দুই প্রধান নায়ক প্লেটো ও এরিস্টটল। সামাজিক জীবন সম্বন্ধে সুসংবদ্ধ চিন্তাভাবনা পাশ্চাত্যে তাদের দ্বারাই শুরু হয়। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা গভীর কল্পনাশ্রয়ী চিন্তা ভাবনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। 
গ্রিক দার্শনিক প্লেটো (Plato) তার "The Republic" গ্রন্থে আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান। তার ছাত্র এরিস্টটল (Aristotle) "The Politics" গ্রন্থে সামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রে অধিকতর বাস্তববাদিতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি মূলত যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সরকারের শ্রেণিবিভাগ ও একটি আদর্শ সামাজিক ব্যবস্থার রূপায়ণে সচেষ্ট হয়েছিলেন। 

ইবনে খালদুন (Ibn Khaldun): ত্রয়োদশ শতকের বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে খালদুন তার 'আল - মুকাদ্দিমা' গ্রন্থে সমাজের গতিবিধি এবং সমাজ জীবনে বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিসমূহের ব্যাখ্যা দেন। তিনি সামাজিক ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে 'Umran' বা 'Umaranayat' প্রত্যয়টির উল্লেখ করেন। এটি সমাজবিজ্ঞানের প্রতিশব্দ হিসেবে পরিচিত। তার মতে , প্রাকৃতিক ঘটনাবলির মতোই সমাজজীবনও কতকগুলো নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। ফলে অতীত ঘটনার দলিল ও বর্তমান ঘটনা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক ঘটনাবলিকে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হন। তিনি রাষ্ট্রের উৎপত্তির মূলে ‘সামাজিক সংহতি' ও দ্বন্দ্বের ভূমিকাসহ রাষ্ট্রের উত্থান - পতনের ব্যাখ্যা দেন। তিনি সমাজজীবনে ভৌগোলিক উপাদানের প্রভাব বিষয়ক তত্ত্বেরও প্রবক্তা। সমাজবিষয়ক তার এ সব চিন্তা - ভাবনার কারণে এ . কে . নাজমুল করিমসহ অনেকেই তাকে সমাজবিজ্ঞানের আদি জনক হিসেবে অভিহিত করেন। 

ম্যাকিয়াভেলি (Machiavelli): ষোড়শ শতকের ইতালির অন্যতম চিন্তাবিদ "The Prince" গ্রন্থের রচয়িতা নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (Niccolo Machiavelli) যে সমাজ দর্শন প্রচার করেছেন তার প্রধান ভিত্তি হলো মানব প্রকৃতি ও মানব দর্শন। তার মতে , মানুষ প্রকৃতিগতভাবে দুষ্টু। মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য হলো তার থেকে শক্তিশালী কোনো শক্তির দ্বারা বাধ্য না হলে সে ভালো কিছু করতে চায় না। মানুষের মধ্যে একইসাথে স্বার্থপরতা এবং কলহপ্রিয়তা বিদ্যমান। এক কথায় মানুষের লোভ - লালসা সীমাহীন, যে কারণে মানুষের মধ্যে সর্বদাই দ্বন্দ্ব - কলহ বিদ্যমান এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত নিয়মনীতি দ্বারা বাধ্য না হলে গোটা সমাজজীবনকেই ব্যহত করতে চায়। 

টমাস মুর (Thomas Moore): ম্যাকিয়াভেলির পরে একই যুগের আরেকজন চিন্তাবিদ হলেন স্যার টমাস মুর ( Thomas Moore )। তিনি তার "Utopia" নামক গ্রন্থে মানুষের দৈনন্দিন সামাজিক সমস্যার সমাধান করে একটি আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান। তিনি এ গ্রন্থে যে পূর্ণ রাষ্ট্রের চিত্র এঁকেছেন তার মাধ্যমে সকল সমাজের সমস্যার সমাধান এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ ন্যায়ের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন প্রকৃতির নিয়ম - শৃঙ্খলাকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে সঠিকভাবে মেনে চলার মাধ্যমে একটি নিখুঁত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।  

ভিকো (Vico): ইতালির দার্শনিক জিয়ামবাতিস্তা ভিকো ( Giambattista Vico ) পাশ্চাত্যে প্রথম ইতিহাস দর্শনের বৈজ্ঞানিক আলোচনার ভিত্তি স্থাপন করেন । যার নাম 'The New Science'। তিনি তার 'The New Science'- এ জাতিসমূহের সাধারণ প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন , মানুষের গবেষণার উপযুক্ত ক্ষেত্র হবে মানুষ। তিনি এটাও মনে করতেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনাবলি বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার উপযুক্ত বিষয়। ভিকোর মতে, সমাজ কতকগুলো সুনির্দিষ্ট নিয়মের অধীন এবং বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ ও পাঠের মাধ্যমে সমাজ বিকাশের সূত্রাবলিকে আবিষ্কার করা যায়। এছাড়া ভিকো সমাজ পরিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা: 
ক. দেবতার যুগ; 
খ. বীর যোদ্ধাদের যুগ; 
গ. মানুষের যুগ। 
তিনি তার ইতিহাস দর্শনে মানব ইতিহাসের ধারার মূল কারণ খুঁজতে গিয়ে মানবসমাজের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে যে সব আলোচনা করেছেন তা এ যুগের বিচারে সমাজবিজ্ঞানের পর্যায়ে ফেলা যায়। 

মন্টেস্কু (Montesquieu): ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু তার ' The Spirit of Laws ' গ্রন্থে সামাজিক সমস্যার বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সমাজ গবেষণার ক্ষেত্রে তার অবদান ভিকোর থেকে বেশি বলে মনে করা হয়। তিনি মানবসমাজ বিকাশে ভৌগোলিক উপাদানের ভূমিকা নিয়েও আলোচনা করেছেন। 

কঁদরসে (Condorcet): ফরাসি দার্শনিক কঁদরসে সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি তার 'Historical Human Mind' গ্রন্থে সমাজ পরিবর্তনের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছিলেন যা পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক মতবাদের বিকাশে সুদুরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল। উপরে উল্লিখিত মনীষীরা রাষ্ট্রচিন্তা, সমাজচিন্তা ও দর্শনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও তাদেরকে সমাজবিজ্ঞানের পূর্বসূরিদের দলে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। কেননা সমাজচিন্তার আলোচনার সূত্রপাত অনেক আগে ঘটলেও একটি আলাদা বিষয় হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের জন্ম মূলত পাশ্চাত্যের শিল্প ও ফরাসি বিপ্লবের ফলে।

 সাইমন ও কোঁৎ (Simon and Comte): ফরাসি চিন্তাবিদ সেইন্ট সাইমন (Saint Simon) শ্রমিক শ্রেণির দুঃখ - দুর্দশা - দেখে বিচলিত হন এবং তা মোচনের জন্য একটি নতুন বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। তিনি সমাজ বিকাশ ও সমাজ পরিবর্তনের একটি নকশা তৈরি করেন। সে নকশা অনুসরণ করে তার ছাত্র অগাস্ট কোঁৎ (Auguste Comte) সমাজ সম্পর্কিত নানা লেখালেখি শুরু করেন এবং ১৮৩৯ সালে সর্বপ্রথম Sociology শব্দটি ব্যবহার করেন। এ কোঁৎকেই আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের জনক বলে অভিহিত করা হয়। তার বিশেষ কৃতিত্ব হলো তিনি 'Sociology' শব্দটির জনক এবং এই বিজ্ঞানের পরিধি ও গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেন। 

১৮৩০ থেকে ১৮৪২ সালের মধ্যে কোঁৎ এর বিখ্যাত গ্রন্থ Positive Philosophy ৬ টি খণ্ডে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটিতে তিনি মানব জ্ঞান বিকাশের ধারা সম্পর্কে একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান। তার মতে , মানুষের সকল চিন্তা - চেতনা, ধ্যান - ধারণাসমূহ জ্ঞানের সকল শাখা এবং পৃথিবীর সকল সমাজসমূহ অত্যাবশ্যকীয়ভাবে তিনটি পর্যায় পার করে এসেছে এবং বস্তুগত ও অবস্তুগত উভয় বিষয়েই তা প্রযোজ্য। তিনি এ তিনটি পর্যায়ের প্রত্যেকটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তিন ধরনের সামাজিক অবস্থার বর্ণনা দেন। এ তিনটি পর্যায় হলো: ধর্মতাত্ত্বিক পর্যায়, অধিবিদ্যাগত পর্যায় ও দৃষ্টবাদী পর্যায়; আর তার মানব জ্ঞানের এই তিনটি পর্যায়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তিন ধরনের সামাজিক ব্যবস্থা হলো-
ক. সামরিক সমাজ (Military society);
খ. আইনগত সমাজ (Legal society); 
গ. বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ (Scientific society)
এছাড়া আরও তিনজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদের নাম উল্লেখ করা যায় , যারা পেশাদার সমাজবিজ্ঞানী না হয়েও সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে মূল্যবান অবদান রেখেছেন। এরা হলেন : 

কার্ল মার্কস (Karl Marx): জার্মান দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্কস বিশ্বাস করতেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা সকল দ্বন্দ্ব - সংঘাত ও শোষণের মূলে কাজ করে। তিনি শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ গঠনে আগ্রহী ছিলেন এবং এ বিষয়ে নানা মতবাদ দেন। তার মতে , প্রতিটি সমাজের মধ্যে শোষিত ও শোষক এ দুটি শ্রেণি বিদ্যমান। এই দুই শ্রেণির সংগ্রামের ফলে সামাজিক পরিবর্তন ঘটে। অগাস্ট কোঁৎ যেমন তার চিন্তাধারায় মানব বিবর্তনের কালসমূহকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছিলেন; কার্ল মার্কসও তেমনি মানব ইতিহাসের স্তরকে ভাগ করেছেন অর্থনৈতিক যুগভেদের মাধ্যমে এবং তিনি পাঁচটি উৎপাদন পদ্ধতি নির্ধারণ করেন। যথা- 
ক. আদিম সাম্যবাদ; 
খ. দাসপ্রথা; 
গ. সামন্তবাদ ; 
ঘ. পুঁজিবাদ ও 
ঙ. সমাজতন্ত্র। 
এছাড়া এশিয়াতে উৎপাদন পদ্ধতি ইউরোপীয় উৎপাদন পদ্ধতি থেকে ভিন্ন হওয়ায় তার নাম দেন এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি। 

চার্লস ডারউইন (Charles Darwin): ইংরেজ প্রকৃতিবিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন (Charles Darwin) - এর বিখ্যাত "The Origin of Species" (1859) গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার সময় থেকেই বিবর্তন সম্পর্কে জীববিজ্ঞানের পঠন - পাঠন ও গবেষণার কাজ শুরু হয়। তিনি জীব জগতের বিবর্তন ধারা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যোগ্যতমের টিকে থাকা (Survival for the fittest) ও টিকে থাকার সংগ্রাম (Struggle for existence) সূত্র দু'টির জন্ম দেন। তার মতে, জীবনযুদ্ধে যোগ্যতমরাই টিকে থাকে। আর অক্ষম ও দুর্বলরা প্রকৃতির নিয়মেই বিলুপ্ত হয়। 

হার্বার্ট স্পেন্সার (Herbert Spencer): ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী হার্বার্ট স্পেন্সার নিজেকে সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মনে করতেন এবং এই নতুন বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টাও চালিয়েছেন। তার এই বিজ্ঞান সামাজিক জীবন ও কার্যাবলি সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতির মতো সমাজের জন্য একটি আলাদা বিজ্ঞানের প্রয়োজন এবং তা সম্ভব। তিনি চার্লস ডারউইনের দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ডারউইনকে অনুসরণ করে স্পেন্সার জীবদেহের সাথে সমাজদেহের তুলনা করে সামাজিক বিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনার সূত্রপাত করেন। তিনি বলেন, মানবসমাজ একটি সহজ ও সরল অবস্থা থেকে বিবর্তিত হয়ে একটি জটিল অবস্থায় রূপান্তরিত হয়। 

সিগমান্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud): অস্ট্রিয়ান মনোবিশ্লেষক সিগমান্ড ফ্রয়েড সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, মানুষ সমাজে বাস করে এবং সমাজের কার্যকলাপ তার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। ফ্রয়েড তার সহজাত জৈবিক প্রবৃত্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সমাজের সূত্র ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন। তার মতে, মানুষ দলবদ্ধ সমাজব্যবস্থায় পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং শাসিত। এছাড়া ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ফ্রেডারিক লো প্লে (Frederic Le Play), আমেরিকান সামাজিক নৃবিজ্ঞানী লুইস হেনরি মর্গান (Lewis Henry Morgan) এবং ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড বার্নেট টেইলর ( Edward B. Tylor ) প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে অবদান রাখেন। 

ফ্রেডারিক লো প্লে (Le play): ফরাসি গবেষক লো প্লে (Frederic Le Play) সমাজবিজ্ঞানের প্রাথমিক উৎপত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে তিনি কর্মজীবী শ্রেণির মানুষের পারিবারিক জীবন ও অর্থনীতি সম্পর্কে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করেছেন। 

মর্গান (Morgan): মার্কিন সামাজিক নৃবিজ্ঞানী লুইস হেনরি মর্গান (Lewis Henry Morgan) ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত গ্রন্থ Ancient Society তে সামাজিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সমাজকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করে তার পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনের ধারা তৈরি করেন। তিনি বলেন, মানব সমাজ বিবর্তিত হয়ে বর্তমান ( সভ্যতা ) রূপ ধারণ করেছে। তার মতে, সমাজ বিবর্তনের তিনটি স্তর বা পর্যায় থাকে। এ তিনটি পর্যায় হলো (ক) বন্যদশা (Savagery), (খ) বর্বরদশা ( Barbarism ) ও (গ) সভ্যতা (Civilization)।

টেইলর (Tylor): ইংরেজ নৃবিজ্ঞানী টেইলরের মতে, সংস্কৃতি হচ্ছে ইতিহাসের বিজ্ঞান এবং তা সাংস্কৃতিক প্রগতির দর্শনের তিনটি স্তর তথা আদিমতা, বর্বরতা ও সভ্যতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি আরও বলেন, সাংস্কৃতিক প্রগতির তিনটি সর্বজনীন স্তর রয়েছে, তবে তিনি এসবকে ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসেবে গ্রহণ করেননি। বরং এগুলোকে পূর্বের অবস্থা পুনঃনির্মাণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বস্তুত সমাজবিজ্ঞানের জন্ম হয় পাশ্চাত্যের শিল্প ও ফরাসী বিপ্লবকালে। এ সময় ইউরোপীয় সমাজে এক বৈপ্লবিক সামাজিক পরিবর্তন সূচিত হয়। 

একথা সত্য যে, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো কোনো স্বতঃসিদ্ধ তত্ত্ব বা সূত্র সমাজবিজ্ঞান এখনো উদ্ভাবন করতে পারে নি, তথাপি সমাজবিজ্ঞানের উন্নতি বয়েই চলেছে। বর্তমানে আধুনিক প্রায় সকল দেশেই এর দ্রুত প্রসার ঘটছে।

সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ও পরিধি

সমাজবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে আজ পর্যন্ত মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সমাজবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে গিয়ে ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎ (Auguste Comte) এ বিজ্ঞানকে দু'ভাগে ভাগ করেন। যথা- 
১. সামাজিক স্থিতিশীলতা (Social statics); 
২. সামাজিক গতিশীলতা (Social dynamics)। 

সামাজিক স্থিতিশীলতা বলতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের আলোচনাকে বোঝায়। আর সামাজিক গতিশীলতা বলতে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান কীভাবে কালের চক্রে পরিবর্তিত হচ্ছে তার আলোচনাকে বোঝায়। সমাজবিজ্ঞানের পথিকৃৎদের অন্যতম ইংরেজ সমাজবিজ্ঞানী হার্বার্ট স্পেন্সার (Herbert Spencer) - এর মতে "সামাজিক বিবর্তনের বিশ্লেষণ, মানুষের জীবনযাত্রার প্রক্রিয়ার ওপর বিভিন্ন বিষয়ের (আচার, অনুষ্ঠান, রীতিনীতি ইত্যাদি) প্রভাব, শিল্প সমাজে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রতিষ্ঠা লাভ ইত্যাদি সমাজবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়।" 

বস্তুত সমাজবিজ্ঞান বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ে পাঠ করে। এটি সামাজিক গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, শ্রেণি, জাতি, জনতা ও বিভিন্ন প্রকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগঠনের মধ্যে দৃশ্যমান হয়। কীভাবে সামাজিকীকরণ ক্রিয়া-প্রক্রিয়া থেকে মানুষের ভাবভঙ্গি ও স্বার্থ জন্ম নেয় এবং কীভাবে চিরাচরিত প্রথা ও অভ্যাসের মাধ্যমে মানুষ অভিন্ন আচার-আচরণের শিক্ষা পায় তাও সমাজবিজ্ঞান পাঠের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া ব্যক্তির বিভিন্ন আচার-আচরণ, রীতিনীতি, এদের বৈশিষ্ট্য ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে পাঠ করার ওপরও জোর দেয়া হয়ে থাকে।

 কার্যত সমাজবিজ্ঞান হলো জ্ঞানের সেই বিশেষ শাখা যা গোটা সমাজকে বিশ্লেষণের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করে। এজন্যই সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে রাশিয়ান সমাজবিজ্ঞানী নিকোলাস এস. টিমাশেফ (Nicholas Sergeyevitch Timasheff) বলেন, though the subject matter of sociological study is men in interdependence , the province of sociology does not embrace every type of study of men in interdependence."
 
বস্তুত মানুষের আচরণ বলতে যা কিছু বোঝায় তার সবই সমাজবিজ্ঞানের আলোচ্য পরিধির অন্তর্ভুক্ত । যেহেতু সমাজকে জানতে হলে সমাজজীবনের বিভিন্ন ধারাকে জানা দরকার , সেহেতু পাঠের সুবিধার্থে সমাজবিজ্ঞানকে বিশেষ বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ভাগ করা হয়েছে , আর প্রত্যেক ক্ষেত্রেরই রয়েছে নিজস্ব পাঠ পদ্ধতি। সমাজবিজ্ঞানের এই বিভক্তিকরণ অপরিহার্য। কেননা সমাজজীবনের সকল দিক সম্পর্কে কোনো একজনের পক্ষে দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব নয় । মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী এলেক্স ইংকলেসের (Alex Inkeles) - এর মতে , সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা যায়। যথা: 
ক. সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ 
১. মানব সংস্কৃতি ও সমাজ 
২. সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
৩. সামাজিক বিজ্ঞানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।

খ. সামাজিক জীবনের মৌল উপাদানসমূহ  
১. সামাজিক কার্যাদি ও সামাজিক সম্পর্ক  
২. ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব; 
৩. গোষ্ঠীসমূহ; 
৪. নগর ও গ্রামীণ সম্প্রদায়; 
৫. সংঘ ও সংগঠন; 
৬. জনসংখ্যা; 
৭. সমাজ।

গ. মৌলিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান
১. পরিবার ও জ্ঞাতি সম্পর্ক
২. অর্থনৈতিক বিষয়াদি 
৩. রাজনৈতিক ও আইনগত বিষয়াদি 
৪. ধর্মীয় বিষয়াদি 

ঘ . মৌলিক সামাজিক প্রক্রিয়া
১. বিভিন্নতা ও সামাজিক স্তরবিন্যাস  
২. সহযোগিতা, অভিযোজন ও আত্মীকরণ 
৩. সামাজিক দ্বন্দ্ব (বিপ্লব, যুদ্ধ ইত্যাদি) 
৪. যোগাযোগ (মতামত গঠন, অভিব্যক্তি ও পরিবর্তন) ৫. সামাজিকীকরণ ও অনুশাসন 
৬. সামাজিক বিবর্তন (মূল্যবোধের অধ্যয়ন)
৭. সামাজিক বিচ্যুতি (অপরাধ, আত্মহত্যা ইত্যাদি) 
৮. সামাজিক সংহতি; 
৯. সামাজিক পরিবর্তন। 

সমাজবিজ্ঞানের পরিধি

একটি প্রায়োগিক বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের পরিধি কোথায় শুরু এবং শেষ হয়েছে তা বলা কঠিন। সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বিষয় হিসেবে সমাজবিজ্ঞান সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যোগসূত্র নির্ণয় এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে। সেজন্য নিউজিল্যান্ডের নৃবিজ্ঞানী রেমন্ড ফার্থ (Raymond Firth ) বলেছেন, "Unless there is stark physical isolation , no society can be given a definite limit." অর্থাৎ সর্বোতভাবে বিচ্ছিন্ন না হলে সমাজের সীমারেখা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। 
কিন্তু প্রকৃতিগত দিক থেকে সমাজ সবসময় পরিবর্তনশীল। মানুষ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সামাজিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির সংস্পর্শে আসছে। ফলে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া যেমন ব্যাপ্তি লাভ করছে , তেমনি সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা ক্ষেত্রও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সমাজবিজ্ঞানের পরিধিও ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। সমাজবিজ্ঞান সমাজের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ। মূলত সমাজবিজ্ঞানের প্রধান আলোচনার বিষয়ই হলো সমাজবদ্ধ মানুষের বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সম্পর্ক। এজন্য সমাজে সংঘটিত সবকিছুই সমাজবিজ্ঞানের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজবিজ্ঞানের প্রধান আলোচ্য বিষয়গুলো হলো-
সমাজতাত্ত্বিক মতবাদ (Sociological theory): প্রত্যেক সমাজবিজ্ঞানী একটি তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিতI সমাজবিজ্ঞানের প্রত্যয়, নীতি এবং সাধারণীকরণ ইত্যাদি সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীদের দেওয়া যেসব তত্ত্ব রয়েছে তা সমাজতাত্ত্বিক মতবাদের অন্তর্ভুক্ত। মূলত সমাজবিজ্ঞানীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু , বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসা, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুসন্ধান, এ সম্পর্কের ব্যাখ্যাদান পদ্ধতি এবং অন্তর্দৃষ্টির রহস্যের মূলে রয়েছে তাত্ত্বিক ভিত্তি। সমাজ কোন নিয়ম দ্বারা শাসিত হচ্ছে, সামাজিক পরিবর্তনের নেপথ্যে কোন শক্তি কাজ করছে ইত্যাদি সম্পর্কে অগাস্ট কোঁৎ (Auguste Comte), কার্ল মার্কস (Karl Marx), এমিল ডুর্খেইম (Emile Durkheim ), ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber), হার্বার্ট স্পেন্সার (Herbert Spencer) প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানীদের দেয়া তত্ত্ব এ শ্রেণিভুক্ত। বস্তুত সমাজতাত্ত্বিক মতবাদ সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন পদ, প্রত্যয়, তত্ত্ব, নীতি এবং জীবনযাত্রা সম্পর্কে বিচার - বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে। 

বিবাহ ও পরিবারের সমাজবিজ্ঞান (Sociology of marriage and family): মানবসমাজের সবচেয়ে আদিম সামাজিক সংগঠন হলো পরিবার। প্রাচীনকালে পরিবারকে কেন্দ্র করেই মানবসমাজের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। সমাজবিজ্ঞান সবচেয়ে আদিম সামাজিক সংগঠন হিসেবে বিবেচনার মাধ্যমে পরিবারের গঠন ও কার্যক্রম সম্পর্কে আলোচনা করে। এজন্য সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান শাখা বা আলোচ্য বিষয় হলো পরিবারের সমাজবিজ্ঞান। পরিবারের উৎপত্তি, বিবর্তন, বিকাশ, ধরন, আধুনিক ও পরিবর্তনশীল পরিবারের কার্যাবলি এবং পরিবারের সমস্যা সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানের এ শাখায় আলোচনা করা হয়। পাশাপাশি পরিবার গঠিত হওয়ার মূল ভিত্তি বিবাহ নিয়েও সমাজবিজ্ঞানের এ শাখা আলোচনা করে। বিবাহ সম্পর্কিত আলোচনায় স্থান, কাল ও পাত্রভেদে বিবাহের ধরন, প্রকৃতি, রীতিনীতি, আচার - অনুষ্ঠান প্রভৃতি বিষয় প্রাধান্য পায়।

ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞান (Historical sociology): সমাজতাত্ত্বিক প্রত্যয়, তত্ত্ব ও গবেষণা পদ্ধতিকে অতীতের পটভূমিতে প্রয়োগ করে সামাজিক পরিবর্তনের ধারা অধ্যয়নের প্রচেষ্টা থেকে ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞানের সূচনা হয়। সমাজবিজ্ঞানের এ শাখায় প্রাচীন সমাজ, সমাজের উদ্ভব, বিকাশ এবং বর্তমান সমাজের জীবনযাত্রা সম্পর্কে গবেষণা করা হয়। ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ এলেক্সিস ডি টকভিলে (Alexis de Tocqueville) - এর The Ancient Regime and the French Revolution 'গ্রন্থটি ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত। 

সামাজিক জনবিজ্ঞান (Social demography): সমাজের অন্যতম উপাদান হচ্ছে জনসংখ্যা । সমাজকাঠামোর রূপায়ণে জনগণের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি । আর তাই সমাজ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন করতে হলে জনসংখ্যার কাঠামো , জনসংখ্যার বণ্টন, জনসংখ্যার বয়ঃকাঠামো, লিঙ্গ কাঠামো, জন্ম - মৃত্যুর হার, আদমশুমারি, স্থানান্তর গমন, জনগণের প্রজনন ক্ষমতা , জনসংখ্যা তত্ত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে জানা অপরিহার্য। এজন্য জনসংখ্যা সম্পর্কিত বিস্তারিত পঠন - পাঠনের জন্য গড়ে উঠেছে সামাজিক জনবিজ্ঞান। 

গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান (Rural sociology): পুরো পৃথিবীতেই নগরের পাশাপাশি গ্রামীণ সমাজও সভ্যতার অগ্রগতিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, সভ্যতার উৎপত্তিই হয়েছে গ্রাম থেকে। সমাজবিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্রেও তাই গ্রামীণ সমাজকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। গ্রামীণ সমাজকাঠামো সম্পর্কে জানার জন্য সমাজবিজ্ঞানের যে নতুন শাখার উদ্ভব হয়েছে, তাকে 'গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান' বলে আখ্যায়িত করা হয়। গ্রামীণ কৃষি কাঠামো, অর্থনীতি, বিবাহ, পরিবার, জ্ঞাতি সম্পর্ক, নেতৃত্ব, ক্ষমতা কাঠামো, মর্যাদা, সমাজকাঠামো ইত্যাদি বিষয়ে গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানে আলোচনা করা হয়। 

নগর সমাজবিজ্ঞান (Urban sociology): সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে নগর সমাজবিজ্ঞান বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। ইতিহাসবিদদের মতে মানুষ বন্য অবস্থা পেরিয়ে সভ্য ও শিল্পায়িত সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে। ফলে নগর জীবনে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের ফলে সমাজের ওপর যে প্রভাব পড়েছে তা ব্যাখ্যা করতে নগর সমাজবিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে। এ শাখা নগরের সমাজ, অর্থনীতি, নেতৃত্ব কাঠামো, ক্ষমতা কাঠামো, মর্যাদা ও সামাজিক স্তরবিন্যাস নিয়ে আলোচনা করে। 

ধর্মের সমাজবিজ্ঞান (Sociology of religion): সমাজজীবনে ধর্মের প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে জাতি, গোষ্ঠীগত পার্থক্য এবং শ্রেণিবিভাজন সৃষ্টি হয়। বস্তুত ধর্ম মানুষের আচরণ, প্রথা, লোকাচার, সাংস্কৃতিক অবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং মানুষের গোষ্ঠীগত নিজস্বতা প্রদান করে। এ বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য ধর্মের সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব। সমাজবিজ্ঞানের এ শাখায় ধর্মীয় রীতিনীতি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ, সামাজিক গুরুত্ব, সমাজ ও ব্যক্তির ওপর প্রভাব, প্রকারভেদ, জাতীয় আন্তর্জাতিক পরিসরে ধর্মের কার্যকারিতা ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করা হয়। 

শিক্ষার সমাজবিজ্ঞান (Sociology of education): শিক্ষার সমাজবিজ্ঞান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য, পাঠ্যসূচি, পাঠ্যবিষয় বহির্ভূত নানাবিধ কার্যকলাপ, শিক্ষা ব্যবস্থার প্রশাসনিক দিক, শিক্ষার মাধ্যম, শিক্ষা ব্যবস্থার ধরন, শিক্ষার সাথে সামাজিক শ্রেণির সম্পর্ক এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। এছাড়া এটি শিক্ষা এবং সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন— অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিধি ব্যবস্থা, জ্ঞাতি সম্পর্ক ইত্যাদির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে পঠন - পাঠন এবং অনুসন্ধান করে। 

রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান (Political sociology): রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিষয়াদির সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি, গোষ্ঠী তথা নাগরিকের সম্পর্ক নির্ণয় করে। সমাজবিজ্ঞানের এ শাখা রাজনৈতিক সংস্কৃতি, উন্নয়ন, আদর্শ ও আন্দোলন এবং পরিবর্তন সম্পর্কে পঠন - পাঠন ও অনুসন্ধান করে। এছাড়া রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেমন— রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কেও আলোচনা করে থাকে। 

সাংস্কৃতিক সমাজবিজ্ঞান (Cultural sociology): সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় সংস্কৃতি হলো মানুষের সার্বিক জীবনপ্রণালি। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে গোটা বিশ্বের লোকজন একে অপরের কাছে আসার সুযোগ পায় এবং এক অঞ্চলের সংস্কৃতির সাথে অপর অঞ্চলের সংস্কৃতির পরিচয় ঘটে। এতে প্রত্যেক জাতির সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ঐতিহ্য, ক্রিয়াকর্ম প্রভৃতি দৃষ্টিগোচর হয়। শুধু তাই নয়, পারস্পরিক পরিচয়ের ফলে বিভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রণও (Culturization) ঘটে। এসব বিষয়ে আলোচনার জন্য সাংস্কৃতিক সমাজবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের এ শাখায় সংস্কৃতির ধরন, প্রকৃতি, স্বরূপ ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করা হয়। 

আইনের সমাজবিজ্ঞান (Sociology of law): সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো আইনের সমাজবিজ্ঞান। এতে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া, সমাজবদ্ধ মানুষের আইনগত অধিকার, কর্তব্য, সমাজে আইনের প্রভাব, কার্যকারিতা ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। পাশাপাশি সমাজের কোন অবস্থার প্রেক্ষাপটে কী ধরনের আইনের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে এ বিষয়টিও আইনের সমাজবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়। 

সামাজিক মনোবিজ্ঞান (Social psychology): ব্যক্তির যে সব আচরণ সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে এবং সেই সাথে সমাজের অন্যান্য সদস্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে সামাজিক মনোবিজ্ঞানে সেগুলো পর্যালোচনা করা হয়। এটি সমাজের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির সহজাত প্রবৃত্তি, ব্যক্তিত্ব, শিক্ষণ, মনোভাব, আবেগ, প্রেষণা, নেতৃত্ব, সামাজিকীকরণের বিভিন্ন মাধ্যম , জনমত, জনসাধারণ, জনতা এবং এ ধরনের অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠী, সামাজিক আন্দোলন, মতাদর্শ প্রচার প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে বিচার - বিশ্লেষণ করে। 

সামাজিক পরিসংখ্যান (Social statistics): সামাজিক পরিসংখ্যান সমাজে সংঘটিত ঘটনাবলির সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচার বিশ্লেষণ করার পন্থা ও কৌশল সম্পর্কে ব্যাখ্যা দান করে। বস্তুত সামাজিক পরিসংখ্যান হচ্ছে সামাজিক ঘটনাবলির তথ্য সংগ্রহ, উপস্থাপন ও বিশ্লেষণের শাস্ত্র। তবে সামাজিক পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যাত্মক তথ্য নিয়েই আলোচনা করে না সেইসাথে গুণাত্মক তথ্য পরিমাপেও এর ভূমিকা রয়েছে। 

শিল্প সমাজবিজ্ঞান (Industrial sociology): শিল্প সমাজবিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা । শিল্প উৎপাদন , বণ্টন , ভোগ ব্যবস্থা ও সমাজকাঠামোর পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার আলোচনা শিল্প সমাজবিজ্ঞানের পরিধিভুক্ত। 

অপরাধ সমাজবিজ্ঞান (Sociology of crime): অপরাধ সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে সামাজিক অপরাধের বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ। সুইস - আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী থর্স্টেন সেলিন (Thorsten Sellin) - এর মতে, আচরণবিধির লঙ্ঘন বিষয়ক পর্যালোচনা অপরাধবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত। অপরাধ, অপরাধ প্রবণতা, দারিদ্র্য, কিশোর অপরাধ, ভদ্রবেশী অপরাধ, অপরাধ সংঘটনে পরিবেশের প্রভাব, অপরাধের কারণ, তত্ত্ব, স্বরূপ, সামাজিক স্থিতিশীলতা ভেঙ্গে পড়া প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে অপরাধ সমাজবিজ্ঞান আলোকপাত করে। 

উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও সমাজবিজ্ঞানের আরও অনেক শাখা রয়েছে। বর্তমান বিশ্বের জ্ঞান - বিজ্ঞানে উন্নত অধিকাংশ দেশেই সমাজবিজ্ঞানের এসব বিশেষীকৃত শাখা - প্রশাখার চর্চা শুরু হয়েছে। এ শাখাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে- জৈবিক সমাজবিজ্ঞান (Biological sociology), তুলনামূলক সমাজবিজ্ঞান (Comparative sociology), পেশার সমাজবিজ্ঞান (Sociology of occupation), দারিদ্র্যের সমাজবিজ্ঞান (Sociology of poverty), 
পরিবেশ সমাজবিজ্ঞান (Sociology of environment), চিকিৎসা সমাজবিজ্ঞান (Medical sociology), লোক সমাজবিজ্ঞান (Folklore sociology), জ্ঞানের সমাজবিজ্ঞান (Sociology of knowledge) , যোগাযোগ সমাজবিজ্ঞান (Sociology of communication), সাংগঠনিক সমাজবিজ্ঞান (Organizational sociology), নন্দন সমাজবিজ্ঞান (Sociology of art), সামরিক সমাজবিজ্ঞান (Military sociology), কাঠামোগত সমাজবিজ্ঞান (Structural sociology), পদ্ধতিগত সমাজবিজ্ঞান (Technical sociology), সাহিত্যের সমাজবিজ্ঞান (Sociology of literature) নামের সমাজবিজ্ঞান (Sociology of name) ইত্যাদি।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url