একচেটিয়া বাজার || Monopoly Market

 একচেটিয়া বাজার কাকে বলে?

যে বাজারে একজন বিক্রেতা বা একটি উৎপাদন প্রতিষ্ঠান কোনো নির্দিষ্ট দ্রব্যের মোট যোগান প্রদান করে তাকে একচেটিয়া বাজার বলে। ইংরেজি 'Monopoly' শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ একচেটিয়া বাজার। 'Mono' শব্দের অর্থ এক এবং 'Poly' শব্দের অর্থ বিক্রেতা। তাই এক বিক্রেতা বিশিষ্ট বাজারকে একচেটিয়া বাজার বলা হয়। 

অর্থনীতিবিদ এ. কুটসোয়ানিস (A. Koutsoyiannis) এর মতে, “একচেটিয়া বাজার হচ্ছে এমন একটি বাজার কাঠামো যেখানে একজন বিক্রেতা থাকে , উৎপাদিত দ্রব্যের কোনো ঘনিষ্ঠ পরিবর্তক থাকে না এবং বাজারে প্রবেশে বাধা বিদ্যমান।"

অর্থনীতিবিদ জি. জে. স্টিগলার (G. J. Stigler) - এর মতে, ''একচেটিয়া কারবার এমন একটি দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদক প্রতিষ্ঠান যার কোনো নিকট পরিবর্তক দ্রব্য নেই।'' 

আর. জি. লিপসির মতে, ''The monopolist is the industry.'' অর্থাৎ একচেটিয়া হলো একটি শিল্প। 

অধ্যাপক ই. এইচ. চেম্বারলিন (Prof. E. H. Chamberlin) - এর মতে, “যে বাজারে ফার্ম বা শিল্পের কোনো বিশেষ পণ্য বা সেবার ওপর বিক্রেতার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে তাকে একচেটিয়া বাজার বলে।” 

একচেটিয়া বাজার
একচেটিয়া কারবার উদ্ভবের মূল কারণ

একচেটিয়া কারবার উদ্ভবের নিম্নোক্ত কারণগুলো উল্লেখযোগ্য। 
১. পণ্যের স্বল্প চাহিদা: কোনো কোনো পণ্যের বাজারে চাহিদা নিতান্তই কম থাকে। তখন একটি ফার্ম হয়তো সেই চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়। এ অবস্থায় অন্য কোন ফার্ম বাজারে প্রবেশ করে লাভবান হবে না বলে মনে করে। তখন সেই পণ্যের বাজারে একচেটিয়া কারবার দেখা দেয়। 

২. উপকরণের গতিশীলতার অভাব: উপকরণ যদি সহজে স্থানান্তরযোগ্য না হয়, তবে উৎপাদকদের মধ্যে উপকরণ নিয়ে কোন প্রতিযোগিতা নাও থাকতে পারে। আবার উপকরণ কখনও কখনও আইনগত বিধি নিষেধের কারণে এক শিল্প থেকে অপর শিল্পে যেতে পারে না। তখন উৎপাদনক্ষেত্রে একচেটিয়া কারবার দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। একইভাবে প্রযুক্তি সম্পর্কিত জ্ঞান কেবল একজনের দখলে থাকলেও একচেটিয়া কারবারের উদ্ভব হতে পারে। 

৩. প্রতিদ্বন্দ্বি ফার্মের মুনাফা সম্পর্কিত অজ্ঞতা: একটি বৃহৎ ফার্ম যখন উৎপাদন পরিচালনা করে তখন তার মুনাফা সম্পর্কে অন্যান্য ফার্ম জানতে পারে না। ফলে বৃহৎ ফার্ম কোন ধরনের কৌশল অবলম্বন করে তার মুনাফা বাড়াচ্ছে, এ সম্পর্কে স্বল্পকালে অন্য ফার্ম সহজে জানতে পারে না । এ অবস্থায় একচেটিয়া কারবার থাকতে পারে। 

৪. ব্যয় সংক্রান্ত সুবিধা: কোন ফার্ম অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ সুবিধা অর্জন করতে পারে। ক্রমহ্রাসমান ব্যয়ের অধীনে উৎপাদন পরিচালিত হলে একটি ফার্ম যত খুশি উৎপাদন করতে পারে। তখন অপর কোন ফার্ম শিল্প ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে বিবেচ্য ফার্ম একচেটিয়া কারবারে পরিণত হয়। 

৫. স্বাভাবিক একচেটিয়া: বাজারের পরিস্থিতি এমনই হতে পারে যে, সেখানে কেবল একটি ফার্ম / প্ল্যান্ট থাকা যুক্তিযুক্ত। যেমন, টেলিফোন ক্যাবল সংযোগ প্রদানে ভিন্ন ভিন্ন ফার্ম / প্ল্যান্ট থাকলে অযথা বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। এমতাবস্থায় একাধিক ফার্ম কাম্য হয় না। যদি বাজারের পরিস্থিতি কেবল একটি ফার্মকে অনুমোদন করে তবে সেক্ষেত্রে যে একচেটিয়া কারবারের উদ্ভব হয়, তাকে স্বাভাবিক একচেটিয়া (Natural Monopoly) বলে। 

৬. সরকারি উদ্যোগ: সাধারণত সরকার সেই কারবারকে অধিগ্রহণ করে, যেখানে অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য / সেবার ক্ষেত্রে ভোক্তারা একচেটিয়া কারবার দ্বারা শোষিত হওয়ার আশংকা থাকে। আবার কখনও সরকার নিজেই পণ্য ক্রয় বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে একক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারে। এভাবেও একচেটিয়া কারবার দেখা দেয়৷ 

৭. প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি: পূর্বাবস্থিত ফার্ম (Existing firm) সীমাবদ্ধ দামনীতি (Limit Pricing Policy) অবলম্বন করতে পারে। নতুন ফার্মের প্রবেশের ক্ষেত্রে এ নীতি বাধা জন্মায়। এ ছাড়া বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার বা উৎপন্ন দ্রব্য পৃথকীকরণ- নতুন ফার্মের অনুপ্রবেশে ক্ষেত্রে বাধা জন্মায়। নতুন ফার্ম তখন উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রবেশের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে একচেটিয়া কারবারী নিজের উৎপাদন চালিয়ে যায়। 

একচেটিয়া বাজারের বৈশিষ্ট্য

১. একক উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বা বিক্রেতা: একচেটিয়া বাজারে সংশ্লিষ্ট দ্রব্যের কেবল একজন উৎপাদনকারী বা বিক্রেতা থাকে। এ কারণে দ্রব্যের যোগান অথবা দামের ওপর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে।
 
২. নিকট বিকল্প দ্রব্যের অনুপস্থিতি: একচেটিয়া বাজারে যে দ্রব্য বা সেবা ক্রয় - বিক্রয় হয় তার ঘনিষ্ঠ পরিবর্তক দ্রব্য বা সেবা থাকে না। ফলে একচেটিয়া কারবারি দ্রব্য বা সেবার দাম অথবা যোগানের ওপর একক প্রাধান্য বিস্তার করে।

৩. দাম অথবা যোগান নিয়ন্ত্রণ: একচেটিয়া কারবারি ইচ্ছা অনুযায়ী দ্রব্য সেবার দাম অথবা তার যোগান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই এ বাজার দাম সৃষ্টিকারী (Price Maker) বাজার। তবে সে একই সঙ্গে উভয় বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। 

৪. বাজারে প্রবেশের পথে বাধা: এ বাজারে যেহেতু কেবল একজন উৎপাদনকারী বা বিক্রেতা থাকে সেহেতু এখানে নতুন কোনো প্রতিযোগীর প্রবেশ কিংবা বাজার ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রশ্ন উঠে না। 

৫. ফার্ম ও শিল্পের মধ্যে পার্থক্য না থাকা: একচেটিয়া বাজারে বিক্রয়যোগ্য দ্রব্যটি কেবল একটি ফার্ম দ্বারা উৎপাদিত হয়। এজন্য এখানে ফার্ম ও শিল্পের মধ্যে পার্থক্য থাকে না। 

৬. বিজ্ঞাপনের অনাবশ্যকতা: একচেটিয়া কারবারির কোনো প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান না থাকায় তাকে প্রতিযোগিতামূলক বিজ্ঞাপনের জন্য কোনো ব্যয় বহন করতে হয় না। 

৭. বিজ্ঞাপন ব্যয় নেই: বিক্রেতা বা উৎপাদনকারীকে বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যয় করতে হয় না। তবে জনস্বার্থে তথ্যমূলক বিজ্ঞাপনের জন্য কিছু পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। 

৮. মুনাফা: এ কারবারে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ইচ্ছামতো দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করতে পারে। 

৯. আড়াআড়ি স্থিতিস্থাপকতা শূন্য: একচেটিয়া বাজারের দ্রব্যে নিকট বিকল্পহীন, ফলে এর আড়াআড়ি স্থিতিস্থাপকতা শূন্য। 

১০. নিম্নগামী গড় আয় বা চাহিদা রেখা: একচেটিয়া বাজারে কম দামে বেশি বিক্রয় অথবা বেশি দামে কম পণ্য সেবা বিক্রয় করা যায়। এ বাজারে তাই দ্রব্যের গড় আয় (AR) বা চাহিদা (D) রেখা ডানদিকে নিম্নগামী হয় এবং প্রান্তিক আয় (MR), গড় আয় থেকে কম হয়। অর্থাৎ AR = D হয় এবং MR < AR হয়।

একচেটিয়া বাজারে ফার্মের ভারসাম্য

একটি একচেটিয়া বাজারে, একটি ফার্ম তার পণ্যের সরবরাহ এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে কারণ এটি উল্লেখযোগ্য প্রতিযোগিতা ছাড়াই কাজ করে। একটি একচেটিয়া বাজারে ফার্মের ভারসাম্য তার চাহিদা এবং খরচ শর্তের মিথস্ক্রিয়া দ্বারা নির্ধারিত হয়। কীভাবে ফার্মটি একচেটিয়া বাজারে ভারসাম্য বজায় রাখে তার একটি ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা এখানে দেওয়া হল:

বাজারের চাহিদা: ফার্ম তার পণ্যের বাজারের চাহিদা বিশ্লেষণ করে শুরু করে। এটি বিভিন্ন মূল্য স্তরে পণ্যের জন্য অর্থ প্রদানের জন্য গ্রাহকদের ইচ্ছুক বোঝার সাথে জড়িত। ফার্মের পণ্যের চাহিদা বক্ররেখা নিচের দিকে ঢালু হয়, যা নির্দেশ করে যে দাম বাড়ার সাথে সাথে চাহিদার পরিমাণ কমে যায়।

প্রান্তিক রাজস্ব: যেহেতু ফার্মটি বাজারে একমাত্র প্রদানকারী, তাই এটি সমগ্র বাজারের চাহিদা বক্ররেখার মুখোমুখি হয়। যাইহোক, চাহিদার পরিমাণের উপর প্রভাব বিবেচনা না করে এটি কেবল যে কোনও মূল্য নিতে পারে না। ফার্মকে বিক্রি করা প্রতিটি অতিরিক্ত ইউনিট থেকে প্রাপ্ত প্রান্তিক আয় (MR) নির্ধারণ করতে হবে। একচেটিয়া বাজারে, MR দামের চেয়ে কম কারণ ফার্মকে একটি অতিরিক্ত ইউনিট বিক্রি করার জন্য সমস্ত ইউনিটের দাম কমাতে হবে।

খরচ বিশ্লেষণ: ফার্মকে তার উৎপাদনের মাত্রা নির্ধারণ করতে তার খরচ কাঠামো বিবেচনা করতে হবে। এর মধ্যে ফার্মের নির্দিষ্ট খরচ এবং পরিবর্তনশীল খরচ বিশ্লেষণ করা জড়িত। স্থির খরচ আউটপুট স্তর নির্বিশেষে খরচ করা হয়, যেমন ভাড়া বা যন্ত্রপাতি খরচ, যখন পরিবর্তনশীল খরচ উত্পাদনের স্তরের সাথে পরিবর্তিত হয়, যেমন কাঁচামাল বা শ্রম খরচ। এর খরচ কাঠামো বোঝার মাধ্যমে, ফার্ম আউটপুটের বিভিন্ন স্তরে ইউনিট প্রতি গড় খরচ নির্ধারণ করতে পারে।

মুনাফা সর্বাধিকীকরণ: ফার্মের লক্ষ্য তার মুনাফা সর্বাধিক করা, যা ঘটে যখন মোট রাজস্ব (TR) এবং মোট ব্যয় (TC) এর মধ্যে পার্থক্য সর্বাধিক করা হয়। আউটপুটের লাভ-সর্বোচ্চ স্তর খুঁজে পেতে, ফার্ম প্রান্তিক রাজস্ব (MR) এবং প্রান্তিক খরচ (MC) তুলনা করে। লাভ-সর্বোচ্চ করার শর্ত হল যেখানে MR সমান MC. আউটপুট এই স্তরে, ফার্ম তার মুনাফা সর্বোচ্চ যে পরিমাণ উত্পাদন এবং বিক্রি.

মূল্য নির্ধারণ: একবার আউটপুটের লাভ-সর্বোচ্চ স্তর নির্ধারণ করা হলে, ফার্ম চাহিদার শর্তের উপর ভিত্তি করে মূল্য নির্ধারণ করে। একটি মুনাফা জেনারেট করার জন্য দাম সাধারণত প্রতি ইউনিট গড় খরচের চেয়ে বেশি সেট করা হয়। যাইহোক, একচেটিয়া প্রতিযোগিতায়, সংস্থাগুলির প্রায়শই কিছু পরিমাণ বাজার ক্ষমতা থাকে এবং তারা তাদের প্রান্তিক খরচের উপরে দাম নির্ধারণ করতে পারে তবে নিখুঁত প্রতিযোগিতার অধীনে প্রত্যাশিত স্তরের নীচে।

লং-রান অ্যাডজাস্টমেন্ট: দীর্ঘমেয়াদে, অন্য সংস্থাগুলি বাজারে প্রবেশ করতে পারে যদি তারা দেখে যে একচেটিয়া সংস্থা অর্থনৈতিক মুনাফা অর্জন করছে। নতুন সংস্থাগুলির এই প্রবেশ প্রতিযোগিতা বাড়ায়, যা একচেটিয়া সংস্থার চাহিদা হ্রাসের দিকে নিয়ে যায়। ফলস্বরূপ, ফার্মের চাহিদা বক্ররেখা সময়ের সাথে সাথে আরও স্থিতিস্থাপক হয়ে ওঠে এবং এটি তার বাজার শক্তি হ্রাস অনুভব করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে, একচেটিয়া ফার্মের ভারসাম্যের সাথে স্বল্প সময়ের তুলনায় কম দাম এবং কম লাভ জড়িত থাকতে পারে।

এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে একচেটিয়া বাজারে ফার্মের ভারসাম্য বাজারের অবস্থা, প্রবেশের বাধা এবং বিক্রি হওয়া পণ্যের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হতে পারে। উপরন্তু, সরকারী প্রবিধান এবং অবিশ্বাস আইন একটি একচেটিয়া ফার্মের আচরণ এবং ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে।

গড় আয় রেখাকে কেন ফার্মের চাহিদা রেখা বলা হয়? 

 আমরা জানি, ফার্মের চাহিদা রেখা বিভিন্ন দামে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদার বিভিন্ন পরিমাণ নির্দেশ করে। একচেটিয়া বাজারে দাম এবং চাহিদার পরিমাণের সম্পর্ক বিপরীত হয় বলে ভোক্তার চাহিদা রেখা এবং ফার্মের চাহিদা রেখা সমার্থক হয়ে পড়ে। আবার AR রেখাও বিভিন্ন দামে বিক্রয়ের বিভিন্ন পরিমাণ নির্দেশ করে। অর্থাৎ প্রতি একক পণ্য কি দামে বিক্রি হয় তা AR রেখা দ্বারা প্রকাশ করা হয়। কাজেই গড় আয় রেখা এবং ফার্মের চাহিদা রেখা ও ক্রেতার চাহিদা রেখা একচেটিয়া বাজারে সমার্থক হয়ে পড়ে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url