শ্রমের ধারণা || Concept of Labour
শ্রম কাকে বলে?
শ্রম বলতে সাধারণত শারীরিক পরিশ্রমকেই বোঝায়। তবে অর্থনীতিতে শ্রম শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। উৎপাদন মানুষের শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম, যার বিনিময়ে অর্থ উপার্জন হয় তাকেই অর্থনীতিতে শ্রম বলে।
অধ্যাপক আলফ্রেড মার্শাল বলেন, ''মানসিক বা শারীরিক যেকোনো প্রকারের পরিশ্রম যা ছাড়া অন্য কোনো উপকারের জন্য করা হয় তাই শ্রম।''
Any exertion of mind or body undergone partly or wholly with a view to some good other than pleasure , derived directly from the work is called labour - Prof . A. Marshal
আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে আন অধ্যাপক নিকোলসনের মতে , “শ্রম বলতে সকল ধরনের সর্বোন্নত পেশাগত দক্ষতাসহ তাদের শ্রমকেও বোঝায় যারা অদক্ষ শ্রমিক ও কারিগর এবং শিক্ষা , শিল্প - কলা , সাহিত্য , বিজ্ঞান , বিচার প্রশাসন ও সরকারের সরল শাখায় নিয়োজিত।”
এই অর্থে মুটে, রিকশাচালক, কামার, কুমোর, তাঁতির কাজ শারীরিক শ্রম এবং শিক্ষক, ভাস্তার, উকিল বিচারক ও প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজ মানসিক শ্রম। তবে কোনো শ্রমই এককভাবে শারীরিক কিংবা মানসিক নয়। প্রত্যেক কাজে শারীরিক ও মানসিক শ্রমের সমন্বয় ঘটে । শ্রমকে দুইভাবে চিন্তা করা হয়। যথা— উৎপাদনশীল এবং অনুৎপাদনশীল শ্রম।
ফিজিওক্রাট মতবাদ: অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে ফিজিওক্রাট নামে পরিচিত এক শ্রেণির লেখকের উদ্ভব ঘটে। তাদের মতে, “যে শ্রম অতিরিক্ত কিছু উৎপাদন করে তাকে উৎপাদনশীল শ্রম বলে। যেমন— কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমই উৎপাদনশীল শ্রম। অপরপক্ষে যে শ্রম অতিরিক্ত কিছু উৎপাদন করে না তাকে অনুৎপাদনশীল শ্রম বলা হয়। যে ব্যবসায় বা এরূপ কাজে নিয়োজিত শ্রমিক।”
ক্লাসিক্যাল মতবাদ : অ্যাডাম স্মিথ , ডেভিড রিকার্ডো, জে. এস. মিল প্রমুখ ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদগণের মতে, যে শ্রামের সাহায্যে দৃশ্যমান বা বস্তুগত দ্রব্য উৎপাদিত হয় তাকে উৎপাদনশীল শ্রম বলে। যেমন – কৃষক, তাঁতি প্রভৃতির শ্রদ উৎপাদনশীল। পক্ষান্তরে যে শ্রমের সাহায্যে দৃশ্যমান বা বস্তুগত কোনো দ্রব্য উৎপাদিত হয় না তাকে অনুৎপাদনশীল শ্রম বলে। যেমন— শিক্ষক, ডাক্তার, উকিল, গায়ক প্রভৃতির শ্রম হলো অনুৎপাদনশীল।
শ্রমের বৈশিষ্ট্য
১. শ্রম একটি জীবন্ত উপকরণ: শ্রমিকের জীবন আছে তাই শ্রম একটি জীবন্ত উপকরণ বা উপাদান। শ্রমিক যতদিন জীবিত থাকে ততদিন শ্রমের অস্তিত্ব থাকে। কারণ শ্রম ও শ্রমিক একই সূত্রে গাঁথা।
২ . শ্রমিক ও শ্রম অবিচ্ছিন্ন : শ্রমিকের মধ্যেই শ্রম দানের ক্ষমতা নিহিত থাকে। শ্রমিক থেকে শ্রমকে বিচ্ছিন্ন করার উপায় নেই। কিন্তু জমির বেলায় জমির মালিক ও জমি ভিন্ন হতে পারে। একইভাবে মূলধনের মালিক ও মূলধন একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন তাদের পৃথক অস্তিত্ব আছে।
৩. শ্রমিক শ্রম বিক্রয় করে কিন্তু নিজেকে নয়: একজন শ্রমিক মজুরির বিনিময়ে তার শ্রম বিক্রি করে কিন্তু নিজেকে নয়। যেমন — একটি পশু ক্রয় করলে তার দেহ ও সেবার মালিক হওয়া যায়। কিন্তু মজুরির বদলে একজন শ্রমিকের কেবল সেবাই নেওয়া যায় কিন্তু তার দেহ ও মনের ওপর অধিকার জন্মায় না।
৪. শ্রমের সচলতা: শ্রম একটি গতিশীল উপাদান। একস্থান থেকে অন্যস্থানে শ্রমিক সহজেই চলাচল করতে পারে। তবে ভৌগোলিক বাধা, ভাষা ও সংস্কৃতির পার্থক্য, পরিবহন ব্যয় এসব শ্রমিক চলাচলের ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
৫. শ্রমের যোগান পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ: জনসংখ্যার আয়তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, শিক্ষা, শ্রমের দক্ষতা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর শ্রমের যোগান নির্ভর করে। এ বিষয়গুলো ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। তাই মজুরি বাড়ানোর সাথে সাথে শ্রমের যোগান বাড়ানো যেমন সম্ভব হয় না, তেমনি মজুরি কমলে তার যোগানও কমানো যায় না। ফলে সময় সাপেক্ষে শ্রমের যোগানের পরিবর্তন হয়।
৬. শ্রমিকের সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ কার্যকর: শ্রমিক মানুষ বলে তার মধ্যে মানবিকতা ও সামাজিকতা উভয়ই বিদ্যমান। শ্রমিকের কাজের সময় ও কাজের প্রকৃতিতে মানবিক দিক বিবেচনা করা হয়। যেমন— শিশুশ্রম মানবিকভাবে কাম্য নয়। শ্রমিকের বয়স ও কাজের সময়সীমা নির্ধারণ সমাজ কাঠামোর প্রেক্ষিতে বিবেচিত হয়।
৭. শ্রমিকের দরকষাকষির দক্ষতা: শ্রম ক্ষণস্থায়ী এবং সংরক্ষণের অযোগ্য। ফলে অব্যবহৃত শ্রম চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। শ্রমের এ ক্ষণস্থায়ী বৈশিষ্ট্যের জন্যই শ্রমিক নিয়োগকর্তার সাথে মজুরির হার নিয়ে বেশি দরকষাকষি করতে পারে না। তাই শ্রমিক খুব কম মজুরিতেও কাজ করতে বাধ্য হয়।
৮. শ্রমের যোগান তুলনামূলকভাবে অস্থিতিস্থাপক: মজুরি বাড়লেও শ্রমের যোগান বাড়তে সময় লাগতে পারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে শ্রমিক সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। দক্ষ শ্রমিকের যোগান সময়সাপেক্ষ, কারণ দক্ষতা অর্জনে সময় লাগে। কাজেই শ্রমের দাম বাড়ানো হলেও শ্রমিকের যোগান বাড়বে এমনটি সব সময় নাও হতে পারে। আর বাড়লেও মাত্রাগত দিক থেকে তা কম হবে।
৯. মজুরি হারের সাথে শ্রমের যোগানের সম্পর্ক বিপরীত: শ্রমের ক্ষেত্রে মজুরি বাড়লে শ্রমিক বিশ্রাম বা অবসর বেশি নেয়। আবার মজুরি কমলে আয় বাড়ানোর জন্য বেশি শ্রম প্রদান করে। ফলে মজুরি হারের সাথে শ্রমের যোগানের সম্পর্ক বিপরীতমুখী।
১০. শ্রম সক্রিয় উপকরণ: ভূমি ও মূলধন নিজে নিজেই উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে না , তাই এরা নিষ্ক্রিয় উপকরণ হিসেবে গণ্য হয়। মানুষ কর্মপ্রচেষ্টা গ্রহণ করলেই কেবল তারা উৎপাদন করতে পারে । তাই শ্রম একটি সক্রিয় উপকরণ হিসেবে গণ্য হয়।
১১. শ্ৰম ক্ষণস্থায়ী: জমি ফেলে রাখলে বা খনিজ সম্পদ অব্যবহৃত অবস্থায় রাখলে তা নষ্ট হয় ন। কিন্তু শ্রমিক শ্রম প্রদান না করলে শ্রমিকের বয়সক্রমে শ্রম ক্ষমতা কমে আসবে। যে সময়ের জন্য শ্রমিক কর্মহীন থাকল, সেই সময় আর ফিরে আসবে না।
কাজেই শ্রম প্রদানের বিষয়টি সময়ের প্রেক্ষিতে ক্ষণস্থায়ী। শ্রম প্রদান না করলে তা মূল্যহীন। কিন্তু জমি ফেলে রাখলেও তা মূল্যবান থাকে।